জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ সমঝোতার নেপথ্যে
এবারও নির্বাচনী মাঠে নেই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধান দলগুলোর নির্বাচনে আসা জরুরি। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া জাতীয় পার্টি (জাপা)। ভোটের মাঠে নিজেদের কদর বাড়াতে নানান ফন্দি-ফিকির করে দলটি। এবারও ‘নাটক’ কম হয়নি। রওশন এরশাদ-জিএম কাদের দ্বন্দ্ব, আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক, রওশন-রাঙ্গা-ফিরোজ রশীদের ছিটকে পড়া এখনো আলোচনায়। শেষমেশ নির্বাচনে আসার ঘোষণা ও ২৬ আসনে দফা-রফা। কী ছিল এই সমঝোতার নেপথ্যে?
নানা নাটকীয়তার পর গত ২৭ নভেম্বর ২৮৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাপা। এরপর শুরু হয় দফায় দফায় বৈঠক। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে আসন বাগানো। শেষ পর্যন্ত ২৬ আসন ছাড়তে রাজি হয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এসব সমঝোতার আসনে প্রার্থী দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। আপস-রফার এ নির্বাচনের বিষয়টি ভালোভাবে নেননি দলটির তৃণমূল নেতারা।
আরও পড়ুন>> জাপার সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, সমঝোতা নাকি সংকটের পথে?
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিনের প্রথমভাগে অনেক জল্পনা জন্ম দিয়ে শেষ বিকেলে জাপা জানায় তারা নির্বাচনে থাকছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকেও জাপা মহাসচিব জানান নির্বাচনে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের চেয়ারম্যান সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
বিকেলে খবর আসে, আওয়ামী লীগ এবার জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিচ্ছে। বিকেল সাড়ে ৩টার পর বনানীতে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। নির্বাচন যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক হয়, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করবো। নির্বাচন করার জন্য সব প্রার্থীকে আজ আমরা চিঠি (প্রতীক বরাদ্দের দলীয়পত্র) দিচ্ছি।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু কিছু আসনে আমাদের অনেক সিনিয়র নেতা আছেন। এসব আসনে যারা নির্বাচন করেন তাদের সঙ্গে আমাদের একটা সমঝোতা হয়েছে বা হবে এমন একটা অবস্থা আছে। কিন্তু নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি এটা বড় কথা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৯টি আসন ছেড়ে দেয়। জাপা ২৩টি আসনে জিতে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় তিনটি আসন কমে যাওয়ায় জাপা নেতারা কিছুটা অসন্তুষ্ট।
আরও পড়ুন>> ১৪ দলের আসন বণ্টন/প্রত্যাশা বেশি, ভাগাভাগিতে আগ্রহ কম
সমঝোতা বৈঠকে জাপা সন্তুষ্ট কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ২৮৩ আসনে ভোট করছি। বেশি আসন জিতে আসতে পারলে সন্তুষ্ট হবো। আমরা যুদ্ধ করবো, খেলে যাবো। আশা করি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক হবে।
যেভাবে হলো সমঝোতা
জাপার একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, গত ৬ ডিসেম্বর গুলশানের একটি হোটেলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও জাপার আরেক কো-চেয়ারম্যান। সেখানে দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে ৪০টির বেশি আসন চায় জাপা। তবে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ। এরপর ৯ ডিসেম্বর ও ১৫ ডিসেম্বর ফের বৈঠক করে দুই পক্ষ, প্রতিবারই আসন কমায় জাতীয় পার্টি। সবশেষ জাতীয় পার্টি ৩১টি আসন দাবি করলে ক্ষমতাসীনরা ২৫টি আসন দিতে রাজি জয়। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর দীর্ঘ আলোচনা করে জাতীয় পার্টি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান, শেষ মুহূর্তে দলটি ঢাকা-৪ আসনে আবু হোসেন বাবলা, ঢাকা-৬ আসনে কাজী ফিরোজ রশীদ, ঢাকা-১ আসনে সালমা ইসলাম, ঢাকা-১৮ থেকে শেরিফা কাদের ও নারায়ণগঞ্জ-৩ থেকে লিয়াকত হোসেন খোকার আসন নিশ্চিত করতে গো ধরেন জাপার শীর্ষ নেতারা। আসনগুলো নিয়ে চাপাচাপি করলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাপাকে আর একটি আসন দেওয়া হবে, সেটি ঢাকা-১৮। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য ছাড়া হবে আসনটি। সব মিলে ২৬টি আসন ছাড়বে তারা। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরিফা কাদেরের আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সরিয়ে দেওয়ার পর দলটির হাইকমান্ড সমঝোতায় রাজি হয়।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, রোববার সকালে আসন সমঝোতায় জিএম কাদের সন্তুষ্ট ছিলেন না। সিলেট-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বসিয়ে শেরিফা কাদেরকে ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়ন দিতে সমঝোতা হয়। এরপর জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয়। ভোটে যাওয়ার ঘোষণায় জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন একাধিক নেতা। আসন সমঝোতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
আরও পড়ুন>> যা থাকছে জাপার নির্বাচনী ইশতেহারে
যশোর-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মুফতি ফিরোজ শাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছি দলটাকে শক্তিশালী করার জন্য। শুধু কেন্দ্রে কয়েকজন এমপি হবেন, এজন্য আমরা কাজ করি না।’
জাতীয় পার্টি উত্তরা পূর্ব থানার সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সমঝোতায় জাতীয় পার্টির মুষ্টিমেয় কিছু লোক সুবিধা পেলো। এভাবে একটা দল চলতে পারে না।’
আরেক নেতা বলেন, ‘এর ফলে পুরোনো ইমেজ তো ফিরে পাবো না। আমরা জনগণের কাছ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলাম।’
সমঝোতার অংশ হিসেবে কেউ কেউ দলীয় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বলেও জানা যায়। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা-১৭ আসনে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের, ঢাকা-৬ আসনে কাজী ফিরোজ রশীদ প্রমুখ।
তবে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিজের ইচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।
আসন সমঝোতায় নাম না থাকলেও দলটির অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবার ছাড়ছেন না নির্বাচনী মাঠ। যাদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-৪ আসনে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জামালপুরের মোস্তফা আল মাহমুদ, যুগ্ম-মহাসচিব চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড আসনে দিদারুল আলম দিদারসহ বেশ কিছু নেতা।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা জাগো নিউকে বলেন, ‘এলাকায় কাজ করেছি। মানুষের সুখে-দুঃখে ছিলাম। নির্বাচন করছি। ভোটের প্রচার শুরু করবো।’
নির্বাচনী মাঠে থাকার কথা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৩ সোনারগাঁ আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, নির্বাচন নিয়ে এলাকায় ব্যস্ত আছি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জয়ী হবো।
জাতীয় পার্টির জন্য যেসব আসন ছাড়লো আওয়ামী লীগ
রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জন্য ২৫টি আসন থেকে দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ-৫ এ বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের আসনে আগে থেকেই প্রার্থী দেয়নি।
যে ২৫ প্রার্থীর প্রার্থিতা আওয়ামী লীগ প্রত্যাহার করেছে তার মধ্যে ৯টিই রংপুর বিভাগের। আসনগুলো হলো ঠাকুরগাঁও-৩ (আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইমদাদুল হক, জাপার হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ), নীলফামারী-৩ (আওয়ামী লীগের মো. গোলাম মোস্তফা, জাপার রানা মোহাম্মদ সোহেল), নীলফামারী-৪ (আওয়ামী লীগের জাকির হোসেন বাবুল, জাপার আহসান আদেলুর রহমান), রংপুর-১ (আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম রাজু, জাপার হোসেন মকবুল শাহরিয়ার), রংপুর-৩ (আওয়ামী লীগের তুষার কান্তি মণ্ডল, জাপার জিএম কাদের), কুড়িগ্রাম-১ (আওয়ামী লীগের আছলাম হোসেন সওদাগর, জাপার এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান), কুড়িগ্রাম-২ (আওয়ামী লীগের মো. জাফর আলী, জাপার পনির উদ্দিন আহমেদ), গাইবান্ধা-১ (আওয়ামী লীগের আফরুজা বারী, জাপার শামীম হায়দার পাটোয়ারী) এবং গাইবান্ধা-২ (আওয়ামী লীগের মাহবুব আরা বেগম গিনি, জাপার মো. আব্দুর রশিদ সরকার)।
রাজশাহী বিভাগের বগুড়া-২ ও বগুড়া-৩ আসনেও জাতীয় পার্টির জন্য নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ। বগুড়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তৌহিদুর রহমান মানিক, জাপার শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। বগুড়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মো. সিরাজুল ইসলাম খান রাজু, এ আসনে জাপার প্রার্থী মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার। খুলনা বিভাগে কেবল সাতক্ষীরা-২ আসনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবুর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। এ আসনে জাপার প্রার্থী মো. আশরাফুজ্জামান।
বরিশাল বিভাগে জাপাকে দেওয়া আওয়ামী লীগের আসন তিনটি। এর মধ্যে পটুয়াখালী-১ আসনে জাপার এ বি এম রুহুল আমীন হাওলাদারের জন্য প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়েছে আওয়ামী লীগের মো. আফজাল হোসেনের। বরিশাল-৩ আসনে জাপার গোলাম কিবরিয়া টিপুর জন্য প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন আওয়ামী লীগের সরদার মো. খালেদ হোসেন। আর পিরোজপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের আশরাফুর রহমান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এ আসনে জাপার প্রার্থী মো. মাশরেকুল আজম (রবি)।
ময়মনসিংহ বিভাগে ময়মনসিংহ জেলায়ই দুটি এবং ঢাকা বিভাগে তিনটি আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আসনগুলো হলো- ময়মনসিংহ-৫ (আওয়ামী লীগের আব্দুল হাই আকন্দ, জাপার সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি), ময়মনসিংহ-৮ (আওয়ামী লীগের মো. আব্দুছ ছাত্তার, জাপার ফখরুল ইমাম), কিশোরগঞ্জ-৩ (আওয়ামী লীগের নাসিরুল ইসলাম খান, জাপার মজিবুল হক), মানিকগঞ্জ-১ (আওয়ামী লীগের আব্দুস সালাম, জাপার জহিরুল আলম রুবেল) এবং ঢাকা-১৮ (আওয়ামী লীগের
হাবিব হাসান, জাপার শেরিফা কাদের)।
এছাড়া সিলেট বিভাগে একটি ও চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চারটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জাপার জন্য। আসনগুলো হলো- হবিগঞ্জ-১ (আওয়ামী লীগের ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী, জাপার মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম চৌধুরী), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (আওয়ামী লীগের শাহজাহান আলম, জাপার মো. আব্দুল হামিদ), ফেনী-৩ (আওয়ামী লীগের আবুল বাশার, জাপার মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী), চট্টগ্রাম-৫ (আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম, জাপার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ) এবং চট্টগ্রাম-৮ (আওয়ামী লীগের নোমান আল মাহমুদ, জাপার সোলায়মান আলম শেঠ)।
এসএম/এএসএ/এমএস