বিএনপির হরতাল-অবরোধ
দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ
সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে হরতাল-অবরোধের সফলতা নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রেফতার ও ধরপাকড় এড়াতে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীলরা আত্মগোপনে। ফলে দলীয় দিক নির্দেশনার অভাবে ভুগছেন মাঠের নেতাকর্মীরা। পুলিশি তৎপরতা ও দলের নির্দেশনা সঠিকভাবে না পৌঁছানোয় দেশের অধিকাংশ জেলায় মাঠে নেই নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় আরও জোরদার কর্মসূচির অপেক্ষায় তারা।
দলীয় সূত্র জানায়, ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ জেলায় হরতাল-অবরোধ ডেকে ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। যদিও এসব মিছিলে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল হাতেগোনা। তবে বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কিছু এলাকায় জোরালোভাবে মাঠে ছিলেন নেতাকর্মীরা। কিশোরগঞ্জ ও লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাধিক নেতাকর্মী হতাহতের ঘটনায় থমথমে অবস্থা। এছাড়া খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী মহানগর ও বিভাগের বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হচ্ছেই না। ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে মাঠের নেতাকর্মীদের দূরত্ব এর কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
গ্রেফতার এড়িয়ে চলার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে দায়িত্বশীলরা তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখছেন না। ফলে কর্মসূচিতেও যথাযথ সমন্বয় হচ্ছে না। এতে হরতাল-অবরোধে সম্মিলিতভাবে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কমছে। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে রুহুল কবীর রিজভী হাতেগোনা কয়েকজন অনুসারী নিয়ে এবং বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুল রহমান খোকন ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ তাদের অনুসারী নিয়ে ঢাকায় ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করছেন।
আরও পড়ুন>> টানা কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিয়েও গুঞ্জন
এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ এবং তার অনুসারীদের কাউকে সেভাবে মাঠে দেখা যায়নি। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির অবস্থাও প্রায় একই। ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ফরহাদ হালিম ডোনার একদিন কয়েকজন সমর্থক নিয়ে মিছিল করেছেন বলে জানা যায়।
চট্টগ্রামে কয়েকজন কর্মী নিয়ে বিএনপির অবরোধ সমর্থনে মিছিল
মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হককে গ্রেফতারের আগেও খুব একটা তৎপর দেখা যায়নি। ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজির টিটু মাঠেই ছিলেন না। ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক ও সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীও আন্দোলনে অনুপস্থিত। গাজীপুরের বিএনপি নেতা রিয়াজুল হান্নানেরও আন্দোলনের মাঠে খোঁজ নেই বলে দাবি কর্মীদের। তবে, গাজীপুরে কালিয়াকৈর বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে দেখা গেছে প্রায় প্রতিদিনই। এছাড়া নারায়ণগঞ্জেও পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে মাঠে ছিল বিএনপি।
গত ২৯ অক্টোবরের হরতাল এবং তারপরে ৪৮ ঘণ্টা করে দুই দফা অবরোধে ছাত্রদলের বেশিরভাগ নেতা মাঠে অনুপস্থিত। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল ও সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে একদিনের কর্মসূচিতে দেখা গেছে মহানগর পূর্বের ঝটিকা মিছিলে। আর সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল মহাসমাবেশের দিন আহত হন। এছাড়া সহ-সভাপতি নাছির উদ্দিন নাছির, যুগ্ম সম্পাদক সাফি ইসলাম রাজপথে নিয়মিত।
সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মুহাম্মদ ইয়াহিয়াকে মহানগর উত্তর বিএনপির মিছিলে একদিন দেখা গেছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখার ছাত্রদল নেতারা সক্রিয় ছিলেন।
ছাত্রদলের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের স্ক্রিনশর্টের কথোপকথন সূত্রে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে না পেয়ে বা তাদের কোনো নির্দেশনা না থাকায় গ্রুপে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকেই। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দফতরকে দিয়ে ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে বলেও ওইসব নেতার অভিযোগ।
এদিকে ছাত্রদলের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের সঙ্গেও দায়িত্বশীল গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীরা যোগাযোগ করতে পারেন না। তার সঙ্গে কার যোগাযোগ হয় এটাও অজানা তাদের। দলের এই কঠিন সময়ে তার ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
পাশে অ্যাম্বুলেন্স পেছনে গণপরিবহন রেখে ঢাকায় যুবদলের মিছিল
যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মিল্টন হরতালে মিছিল করেন সাইনবোর্ড এলাকায়। তারা সেখানে অ্যাম্বুলেন্সযোগে যান। একটা ছবিতে দেখা যায়, পাশে একটি অ্যাম্বুলেন্স রেখে মিছিল করছেন তারা। ওই মিছিলের পাশে রয়েছে গণপরিবহনের যানজট। মিছিল চলাকালে তাদের পাশে গণপরিবহন থাকার ছবিটি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এছাড়া তাদের পরে আর রাজপথে দেখা যায়নি।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে গুলিতে আহত হন। তবে, সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানকে মাঠে দেখা যায়নি। সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসানকে মাঠে দেখা গেছে প্রায়ই দিনের কর্মসূচিতে।
আরও পড়ুন>> মহাসমাবেশের আগের দিন বিএনপির ৪৭৩ নেতাকর্মী কারাগারে
কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহীন ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল ঝটিকা মিছিল করলেও প্রায় প্রতিদিন তারা মাঠে ছিলেন। শ্রমিক দলের তেমন খবর পাওয়া যায়নি। মৎস্যজীবী দলের সদস্য সচিব আব্দুর রহিমকে একদিন শুধু মাঠে দেখা যায়।
অবরোধে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদের গাড়িতে করে আদালতে হাজিরা দেওয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হাফিজ ইব্রাহিমের নৌযান চলা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
অবরোধের মধ্যে গাড়িতে সুলতানা কোর্টে হাজিরা দিতে যান
অপরদিকে, ঢাকার বাইরের বেশিরভাগ জেলায় কর্মসূচি খুব একটা পালন হচ্ছে না। শুধু বগুড়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার নেতাকর্মীরা বেশ সক্রিয়। সেখানে বিএনপি নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর এবং জেলা সভাপতি শরিফুল আলম কারাগারে যাওয়ার পর আন্দোলনের গতি কমে গেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ মোটামুটিভাবে সক্রিয়।
রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে লালমনিরহাটে রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তবে সেখানে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর এখানেও আন্দোলনে নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। আর রাজশাহীতে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় একদিন মিছিল হয়েছে।
চট্টগ্রামেও নেতাকর্মীরা হরতাল-অবরোধের সমর্থনে বিক্ষিপ্তভাবে মাঠে ছিল। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার নেতাকর্মীরা ছিল বেশি সক্রিয়। কুমিল্লায় কর্মসূচি চলাকালে নেতাদের দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মুস্তাক আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার প্রত্যেকটি এলাকায় নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। দিন দিন এ কর্মসূচি আরও জোরালো হবে।’
রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোরশেদ আলম বলেন, ‘এত ধরপাকড়ের মধ্যেও নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামছে। আমাদের আন্দোলন সামনে আরও জোরদার হবে।’
আরও পড়ুন>> সারাদেশে সহিংসতার ঘটনায় র্যাবের হাতে গ্রেফতার ২৬
বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান একদিন ৮-১০ জন লোক নিয়ে মাঠে নেমে গ্রেফতার হয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করেছেন। পুলিশের এই তৎপরতার মধ্যে তিনি কয়েকজন কর্মী নিয়ে মাঠে নেমে গ্রেফতার হওয়ায় নানা আলোচনা হচ্ছে।
আন্দোলনের সময় সরগরম থাকা খুলনা মহানগরের পরিবেশ এবার একেবারে ভিন্ন। এবার সেখানে মিছিল বা পিকেটিং নেই। খালিশপুর থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক কাজী সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দলের কর্মী বা সমর্থক হিসেবে কর্মসূচি পালিত না হওয়ায় কষ্টে আছি।’
মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা এবার খুলনায় কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখিনি। হতবাক হয়েছি। আন্দোলনে খুলনা অন্যতম। অথচ এবার ব্যতিক্রম।’
খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক তারিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্বের কারণে খুলনা বিএনপির আজ এ অবস্থা। দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দিয়ে খুলনা বিএনপি চলতে পারে না এটা এবার আবারও প্রমাণিত। হাইকমান্ডের বিষয়টি বিচেনায় আনা উচিত।’
যশোরে প্রায় প্রতিদিন মিছিল হচ্ছে। সেখানে নেতৃত্বে দেন বিভাগীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। এছাড়া কুষ্টিয়া জেলা বিএনপিরও একদিন মিছিলের খবর পাওয়া গেছে। খুলনা বিভাগের বাকি আট জেলায় কর্মসূচি তেমন একটা পালিত হচ্ছে না বলে খোদ কর্মীদের অভিযোগ।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল-অবরোধ গ্রহণ করেছে। ব্যাপক পুলিশি অভিযানের পরও নেতাকর্মীরা কৌশলের সঙ্গে মাঠে রয়েছে।’
জানা যায়, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের যেসব মিছিল-সমাবেশ বা পিকেটিং হচ্ছে সেটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায়। তার নির্দেশনায় সব সংগঠনের দফতর থেকে ইউনিটে রাতে নির্দেশনা পাঠানো হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিটের কর্মীরা কর্মসূচি বাস্তাবায়ন করছেন। এছাড়া কারা মাঠে আছেন আর নেই তার খবর রাখতে তিনি মনিটরিং সেল গঠন করেছেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেখুন আমাদের প্রত্যেকটি কর্মসূচি সফল হচ্ছে। কারণ সুযোগ পেলেই মানুষ আসছে। কঠিন অবস্থা চলছে, কিন্তু আন্দোলনও চলছে।’
তিনি বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীরা মাঠে আছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে কৌশলী ভূমিকা রাখতে হয় নেতাকর্মীদের। এবারও তার বাইরে কিছু নয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘সরকার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। সিনিয়ররা গ্রেফতার হলেও মধ্যম সারি ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নেতৃত্ব দেবেন। বিএনপি মাঠে আছে। আগামীতে থাকবে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।’
কেএইচ/এএসএ/এমএস