দুর্গাপূজায় আন্দোলন নয়
সাম্প্রদায়িক দলের ‘অপবাদ’ ঘোচাতে কৌশলী বিএনপি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির গায়ে লেগে থাকা সাম্প্রদায়িক দলের তকমা বেশ ভুগিয়েছে। আর সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে করা হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম ভোটব্যাংক। আওয়ামী লীগ নেতারাও সব সময় নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দল দাবি করে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের জন্য বিএনপি ও তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে দায়ী করে আসছে। সাম্প্রদায়িক দলের সেই ‘অপবাদ’ ঘোচাতে বেশ কৌশলী বিএনপি।
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে আগামী নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন এক নির্বাচন কমিশনার।
জাতীয় নির্বাচনের আগে এবারের দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে। সে কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব পড়তে পারে। পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে ফায়দা লুটতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো।
আরও পড়ুন>> সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিএনপি: তথ্যমন্ত্রী
ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির আশঙ্কা ছিল, যেহেতু তারা সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, তাই পূজামণ্ডপে কোনো একটি মহল হামলা চালিয়ে তাদের ওপর দোষ চাপাতে পারে। সে কারণে আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করেছে তারা। দুর্গোৎসব উপলক্ষে বিএনপি তাদের সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন কর্মসূচিতে বিরতি দিয়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিএনপিকে অভিযুক্ত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। যে কারণে নেতাকর্মীরা এবারের দুর্গাপূজায় সতর্ক। যে কোনো পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সনাতন ধর্মালম্বীদের পাশে থাকার দলীয় নির্দেশনা রয়েছে।
সূত্রের দাবি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন উৎসব বা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সব সময় অভিযুক্ত করার চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিএনপির একটা দূরত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, যা বাস্তবতা বিবর্জিত। চলমান সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিএনপি পড়তে চায় না। সে কারণে সরকার পতনে বিএনপির এক দফা আন্দোলন কর্মসূচিতে বিরতি দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না হয় বা কেউ সৃষ্টি করলে দোষীকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সোপর্দ করা যায়, সে বিষয়ে নেতাকর্মীদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।
আরও পড়ুন>> সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে রাজনীতি করে বিএনপি: কাদের
গত ১৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সামনে পূজা আছে। আমরা অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি। আমরা চাই না আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সরকার সমস্যার সৃষ্টি করুক।
জানা যায়, পূজার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে যেন কোনো ধরনের বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সে কারণে বিএনপিপন্থি সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের পক্ষ থেকে গত ১৫ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে সংগঠনটির চেয়ারম্যান এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দুর্গোৎসব কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন।’
আরও পড়ুন>> ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা পূজামণ্ডপে হামলা করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে বহির্বিশ্বকে দেখানোর চেষ্টা করতে পারে। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করে। ব্যবহার শেষ হলে আবার আক্রমণও করে। দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে অতীতেও দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা রাজনৈতিক কারণে ঘটানো হয়েছে। এবারও আমরা এমন আশঙ্কা করছি।’
দেশের সব দল ও ব্যক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিজন কান্তি বলেন, ‘আপনারা সতর্ক থাকবেন। প্রয়োজনে মণ্ডপে পাহারায় থাকবেন। ক্ষমতাসীনদের নীলনকশা যেন বাস্তবায়ন না হয়।’
সম্প্রতি কুমিল্লায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলে হামলার বিষয়ে তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিএনপি। দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকার, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন।
আরও পড়ুন>> ১০ লাখ লোক নিয়ে ঢাকা অবরোধের পরিকল্পনা বিএনপির
পূজায় সতর্কতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কক্সবাজারের রামু বা কুমিল্লার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার কারণে বিএনপি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অতীতের এসব ঘটনা ক্ষমতাসীনরা ঘটিয়ে বিএনপিকে দায় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবার যেন এ ধরনের পরিস্থিতি তারা না ঘটাতে পারে সেজন্য নেতাকর্মীদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।’
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। যে কারণে দুর্গাপূজার সময় আমরা কর্মসূচি দেইনি। যে কোনো পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সর্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব গিয়েছিলেন। গুলশান-বনানী পূজা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’
কেএইচ/ইএ/জেআইএম