নির্বাচন-আন্দোলন
বিএনপির ‘ধীরে চলো নীতির’ নেপথ্যে বিদেশি সিগন্যালের অপেক্ষা!
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে মতদ্বৈধতা। বিশেষত, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর বিপরীত মেরুতে অবস্থান প্রবল হচ্ছে। প্রতিদিনের তর্ক-বিতর্ক আর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও উত্তাপ ছড়াচ্ছে ভোটের হাওয়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন প্রক্রিয়ায় ভোট হবে, আদৌ রাজপথের অন্যতম প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি ভোটে অংশ নেবে কি না, এ নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আর সেই অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকার, নির্বাচন কমিশন কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়।
তবে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকেই বিদেশনির্ভরতা রয়েছে বিএনপির। আগামী দিনে দলটির আন্দোলন-সংগ্রামের গতিপথ কী হবে, তা-ও অনেকাংশে নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থানের ওপর। আর সে আলোচনা এখন আরও জোরদার করেছে, বিএনপির এক দফার যুগপৎ আন্দোলনের ‘ধীরে চলো নীতি’।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসানীতিতে শঙ্কা-সম্ভাবনার দোলাচলে বিএনপি!
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাত্র একমাস বাকি থাকলেও সরকার পতনের আন্দোলনে দলটির ‘ধীর চলো নীতির’ নেপথ্যে বিদেশিদের সিগন্যালের অপেক্ষা রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। দলটির নেতারা সভা-সমাবেশে আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে নানা সময়ক্ষণ বা আলটিমেটাম দিলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় দলটির তৃণমূলে এক ধরনের অনাস্থা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশাও।
বিএনপির আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলন। আওয়ামী লীগ এটা স্বীকার না করে বলে, বিএনপি পারে না। আওয়ামী লীগ চায় তারা যেভাবে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ ও ২০০৭ সালে আন্দোলন করেছে, বিএনপিও একই ভাবে আন্দোলন করুক। ২০১৪ সালের আন্দোলনে যতই বিএনপির সহিংসতার কথা বলা হোক না কেন সেটা বড় কথা নয়।
যদিও বিদেশনির্ভরতার বিষয়ে কর্ণপাত না করে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকে জোর গলায় বলছেন, বিএনপি দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করে, বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে নয়। তারা মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনদিনের মধ্যে পাল্টে যেতে পারে। আর সেটা হতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
বাংলাদেশের ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বা হস্তক্ষেপ বিষয়ে সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওবায়দুল কাদের বলেন, কেউ নিষেধাজ্ঞা দেবে না, তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শত্রুতা কারও সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন, আর কোনো চিন্তা নেই।
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল বলেন, অতীতের মতো সরকার আবারও একতরফা নির্বাচনের জন্য একটা বাগান সাজিয়েছে। কিন্তু এবার জনগণ ও বিশ্ব সম্প্রদায় সব চেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: মার্কিন ভিসানীতি দুরভিসন্ধিমূলক: ১৪ দল
দুই দলের শীর্ষ নেতাদের এমন বক্তব্যের পর বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, দলের নেতাকর্মীদের কাছে বিষয়টি এখন আরও স্পষ্ট যে, আন্দোলন বা নির্বাচন কেমন হবে সবই নির্ভর করছে পশ্চিমাদের নীতির ওপর।
বাংলাদেশে যে ভোট চুরির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটি এখন দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। যার বড় প্রমাণ মার্কিন ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের পদক্ষেপ ইতিবাচক। দল হিসেবে বিএনপির একটা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে। মানুষের চাওয়া অনুযায়ী দলের কর্মসূচি নির্ধারণ হয়।
শুরু থেকেই বিএনপির চাওয়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, নভেম্বরের শুরুর দিকে তফসিল আর জানুয়ারিতে ভোট হওয়ার কথা। সে হিসেবে তফসিলের আর মাত্র এক মাস সময় হাতে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে ১০ দফা ও পরবর্তীকালে গত ১২ জুলাই থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। টানা ১৮ দিন এ কর্মসূচি ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে শেষ হয় গত ৫ অক্টোবর। এরপর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির শেষ দিন অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি দুর্গাপূজার পর লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
তফসিল ঘোষণার আর মাত্র একমাস বাকি থাকলেও দলটি কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ায় তৃণমূলেও হাতাশা সৃষ্টি হয়েছে। পদ হারানোর ভয়ে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে চান না। তবে ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ বাড়ছে। এ নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্য এরকম- রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে তিনদিন বা একদিন যথেষ্ট সময়।
আরও পড়ুন: সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্তির ১ দফা ঘোষণা
অনেকেই বলেছেন, র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটির ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণায় রাজনীতির মাঠে বিএনপি বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায়। ভিসানীতির ঘোষণা বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার করে। সবশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণায় বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি আরও চাঙা হয়ে ওঠে। এছাড়া সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে রেজুলেশন পাস হয়েছে। ইইউ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশিদের আরও অনেকেই এখন সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে না হাঁটলে আগামীতে এসব দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি নিতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্ব সহিংসতা চায় না। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে সহিংসতামুক্ত জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি চায়। তাদের এ ধরনের চাওয়ার বাইরে যাওয়ার খুব বেশি সুযোগ আমাদের নেই। সঙ্গত কারণে দলও সে পথে হাঁটছে। আন্দোলন কর্মসূচি বা নির্বাচন যা-ই বলা হোক না কেন, পশ্চিমাদের পরামর্শের প্রভাব থাকছেই।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে রেজুলেশন পাস হয়েছে। ইইউ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তও জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশিদের আরও অনেকেই এখন সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে না হাঁটলে আগামীতে এসব দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি নিতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্ব তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনের সম্পর্ক না থাকলেও তাদের উদ্যোগ সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে।
পশ্চিমাদের উদ্যোগ বা মার্কিন ভিসানীতি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে, এটা স্বীকার করলেও বিএনপি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আন্দোলন করে না বলে দাবি করেছেন দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলন। আওয়ামী লীগ এটা স্বীকার না করে বলে, বিএনপি পারে না। আওয়ামী লীগ চায় তারা যেভাবে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ ও ২০০৭ সালে আন্দোলন করেছে, বিএনপিও একই ভাবে আন্দোলন করুক। ২০১৪ সালের আন্দোলনে যতই বিএনপির সহিংসতার কথা বলা হোক না কেন সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে পত্রিকায় প্রতিবেদন এসেছে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি থেকে পেট্রলবোমা উদ্ধার হয়েছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা পেট্রলবোমা মারার সময় গ্রেফতার হয়েছে।
আরও পড়ুন: উপেক্ষিত জনদুর্ভোগ, মনোনয়নে মনোযোগ নেতাদের
তিনি দাবি করেন, বিএনপির আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দেওয়া আওয়ামী লীগের এক ধরনের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সেটাকে এড়িয়ে সতর্কভাবে আমাদের গণমুখী আন্দোলনে গণমানুষের সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এটাকে অনেকে বলছে, আমরা নাকি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। না, আমরা বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আন্দোলন করছি না। আমাদের কর্মসূচিতে দেশের জনগণ অংশ নেয়, বিদেশিরা নয়।
ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম আরও বলেন, সামনে শারদীয় দুর্গাপূজা। তার আগেই ১৮ তারিখ ঢাকায় গণজমায়েত। পূজার আগে আর কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন, আমরা নাকি আন্দোলনের নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে সহিংসতা করবো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সহিংসতার প্ল্যানটা তাদেরই। তারাই এ ধরনের সহিংসতা ঘটাতে চায়। উল্টো দোষ চাপাতে চায় বিএনপির ওপর। এ কারণে হিসাব-নিকাশ করেই আমরা কর্মসূচি দিচ্ছি।
আন্দোলন কর্মসূচিতে বিদেশিদের পরামর্শ নেওয়ার বিষয়টি ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আন্দোলন চলছে। যথাসময়ে আন্দোলনের ধরন পরিবর্তন করে গতি বাড়ানো হবে।
আরও পড়ুন: হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিদেশবিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে যে ভোট চুরির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটি এখন দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। যার বড় প্রমাণ মার্কিন ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের পদক্ষেপ ইতিবাচক।
তিনি বলেন, দল হিসেবে বিএনপির একটা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে। মানুষের চাওয়া অনুযায়ী দলের কর্মসূচি নির্ধারণ হয়। এক্ষেত্রে অন্য কারও পরামর্শ নেওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। দল আন্দোলনে আছে। সামনে দাবি আদায়ে যে কোনো কঠোর কর্মসূচি আসবে।
কেএইচ/এমকেআর/এসএইচএস/জেআইএম