অনমনীয় রাজনৈতিক মনোভাব, সংঘাতের দিকে ঝুঁকছে দেশ

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৫৭ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শিগগির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় আগামী বছরের জানুয়ারি। মাত্র কয়েক মাস বাকি থাকলেও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখনো বাগযুদ্ধ চলছেই। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষ নিজ নিজ দাবি বা অবস্থানে অনড়। এ অবস্থায় ঘনীভূত হচ্ছে সংকট। জনমনে তৈরি হচ্ছে শঙ্কা।

পাড়ার চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে বন্ধু মহল, অফিস-আদালত, সংবাদ-টকশোসহ সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এ নির্বাচন। কেমন হবে আগামী সংসদ নির্বাচন? বিএনপি বা সমমনা দলগুলো অংশ নেবে কি না? ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতোই হবে এ নির্বাচন? প্রধান দুই বড় দল অনড় অবস্থানের পরিণতি কী? এমন সব প্রশ্নই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

আরও পড়ুন>> রাজনীতির সমাধান রাজপথে হলে সংঘাত অনিবার্য

সাধারণ মানুষের এসব প্রশ্ন নিয়ে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে— তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের তৃণমূল নেতা ও কেন্দ্রীয় নেতা, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশিষ্টজনের সঙ্গে।

 

সমঝোতা না হলে তো সংঘাত অনিবার্য। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি দেশকে সেই সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন, নাকি সমঝোতা করবেন। এটা তাদের ওপর নির্ভর করছে।— সুজন সম্পাদক

 

‘সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে হবে’, এটি আওয়ামী লীগের এক দফা দাবি। বিপরীতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর দাবি, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।’ সম্প্রতি দেশি-বিদেশি নানান পক্ষের আলোচনা ও প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি কোনো দল। তফসিল ঘোষণার দিনক্ষণ দ্বারপ্রান্তে, এমন সময়ে দুই দলের অনড় অবস্থান সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ তৈরি ফেলছে। এ নিয়ে ভয়ও আছে অনেকের মধ্যে। সরকার সমর্থকদের চিন্তা, ‘সবকিছু সামাল দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে থাকতে পারবে আওয়ামী লীগ?’ বিরোধীরাও ভাবছে- ‘এবারও আন্দোলন করে সফল না হলে অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে তো?’ যদিও উভয়পক্ষই প্রকাশ্য আলোচনায় নিজেদের বেশ আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন।

আরও পড়ুন>> গভীর সংকটে কোণঠাসা সরকার, পতন অনিবার্য: ফখরুল

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দু’পক্ষ তাদের দাবিতে অনড়। যদিও আমরা মনে করি, কখনো না কখনো তারা একটা সমঝোতায় যাবে বা সমঝোতা করার চেষ্টা করবে। যদি সমঝোতা না হয়, কিছুটা সংঘাত তো হবেই। আমাদের সংবিধানে যা আছে, সেটাকে সামনে রেখে ভবিষ্যদ্বাণী ওইভাবে করা সম্ভব নয়।’

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমঝোতা না হলে তো সংঘাত অনিবার্য। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি দেশকে সেই সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন, নাকি সমঝোতা করবেন। এটা তাদের ওপর নির্ভর করছে।’

 

সরকার সমর্থকদের ধারণা— এরই মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আন্দোলনে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে পারবে না। চলমান এ পরিস্থিতির মধ্যেই আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করে ফেলবে। তেমন পরিবর্তন হবে না।

 

আরও পড়ুন>> একদফার আন্দোলনে সব বিরোধী দলকে রাজপথে নামার আহ্বান ফখরুলের

এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান, আরপিও, নির্বাচন কমিশন আইন ও বিধিমালা, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালাসহ জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত সব আইন ও বিধি মোতাবেক কোনো সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার সুযোগ নেই। নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, সরকারের অধীনে নয়। সরকার থাকবে নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যাবলি ছাড়া রুটিন কাজ সম্পন্ন করা এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। সংঘাতমূলক পরিস্থিতি উদ্ভবের সব চেষ্টা জামায়াত-বিএনপি করবে। তা প্রশমন ও দমন করার সক্ষমতা সরকারের রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা আসন্ন নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কায় আছেন, তাদের উচিত নির্বাচন কমিশন এবং প্রচলিত আইন ও বিধিগুলোর প্রতি অধিকতর মনোনিবেশ করা। বাংলাদেশের সংবিধান এবং নির্বাচনকালে প্রযোজ্য সব আইন ও বিধির মধ্যে স্থায়ী সমাধানের পথ রয়েছে।’

আরও পড়ুন>> নির্বাচন নিয়ে কারও মাতব্বরি সহ্য করবো না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

উভয় দলের অনড় অবস্থানে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন কি না? এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত দুই নির্বাচনে (২০১৪ ও ২০১৮) মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ আছে। মানুষ ভোট দিতে চায়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তাদের কিছু সুবিধাভোগী নামসর্বস্ব দল ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের জেদ, অনমনীয়তা, অসহিষ্ণুতা এবং ক্ষমতা না ছাড়ার প্রবণতা দেশকে অবশ্যম্ভাবী রক্তপাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’

এ বিষয়ে কথা হলে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু জাহির বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপন করেছিলাম। তৎকালীন সরকারপ্রধান খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।’ তখন তাদের কর্মকাণ্ড আর আমাদের আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছে। তারা বাধ্য হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে।’

‘পরবর্তীসময়ে কোর্ট এ ব্যবস্থাটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। যদিও অবজারভেশনে কোর্ট এও বলেছে, সংসদ যদি মনে করে আরও দুই মেয়াদে সেটা থাকতে পারে। তখন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেন। যেখানে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদসহ অনেকে ছিলেন। এটা নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিরা কোনো বৈঠকে এসে কোর্টের অবজারভেশন ফলো করার প্রস্তাব দেননি। যে কারণে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আমরা কোর্টের রায়টাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।’

আরও পড়ুন>> বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আ’লীগের জামানত থাকবে না: জয়নাল আবেদীন

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ছাড়া একটা দেশের সরকার গঠনের বিকল্প নেই। এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অযৌক্তিক। এ দাবির সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়া জনগণ নেই। স্বাধীন দেশে কেউ সংঘাত করে রেহাই পাওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।’

 

সরকারবিরোধীদের ধারণা— এবার আর পারবে না আওয়ামী লীগ। আসছে বিএনপি-জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন, মার্কিন ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞাসহ নানা চাপে সরকার হটতে বাধ্য হবে। সেটা নির্বাচনের আগে হোক বা পরে।

 

এ সংক্রান্ত আলোচনায় সরকারের এক ডাকসাইটে আমলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ নিয়ে প্রশাসনেও ভীতি আছে কিছুটা। শুধু প্রশাসন কেন, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে এ নিয়ে যে কারোরই উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। তবে, বিষয়টি রাজনৈতিক। এর সমাধানও রাজনীতিবিদদের করতে হবে। রাজনীতি এখন কতটা রাজনীতিবিদদের হাতে আছে, সেটাই প্রশ্ন।’

আরও পড়ুন>> ‘সরকারি চাল কি শেখ হাসিনার চাল’ আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্যে তোলপাড়

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. কামাল হোসেনবলেন, দু’পক্ষের অনড় অবস্থানে একটা সংকট তো তৈরি হয়েই আছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বাইরের কোনো শেল্টার পেলে সংঘাত করতে চেষ্টা করবে। তবে, প্রশাসনের পাশাপাশি সরকার সমর্থক ছাত্র ও যুব সংগঠনসহ দলগত ঐক্য থাকলে সেটি মোকাবিলা করা সম্ভব।

সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা সরকার সমর্থক, তাদের ধারণা— এরই মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আন্দোলনে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে পারবে না। চলমান এ পরিস্থিতিরি মধ্যেই আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করে ফেলবে। তেমন পরিবর্তন হবে না।

আরও পড়ুন>> প্রধানমন্ত্রী টাকা পাচারের সুযোগ দিয়েছেন: রিজভী

সরকারবিরোধীদের ধারণা— এবার আর পারবে না আওয়ামী লীগ। আসছে বিএনপি-জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন, মার্কিন ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞাসহ নানা চাপে সরকার হটতে বাধ্য হবে। সেটা নির্বাচনের আগে হোক বা পরে।

এসইউজে/এমএএইচ/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।