সালাহ উদ্দিনের পর এবার ‘সুলতানি দৌড়’, বিব্রত বিএনপি
একদিন আগেই নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। পরদিন ২৯ জুলাই ছিল ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে দলটির অবস্থান কর্মসূচি। ওইদিন রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার মাতুয়াইলে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীসমেত স্লোগান দিচ্ছিলেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। সেখানেই ঘটনার অবতারণা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, নেতাকর্মীদের সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন যুবদল সভাপতি। কিন্তু হঠাৎই তাকে দৌড়ে পিছু হটতে দেখা যায়।
পরে জানা যায়, পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে সেদিকে তেড়ে আসছিল। সে কারণেই তিনি পেছনের দিকে দৌড় দেন। এসময় তার সঙ্গে থাকা বিএনপির মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামসহ অন্য নেতাদেরও দৌড় দিতে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকার পতনে বিএনপির এক দফা আন্দোলন যখন জোরালো হচ্ছে, ঠিক এমন সময় যুবদল সভাপতির এ পশ্চাৎপসরণের কৌশল নিয়ে খোদ দলের ভেতরেই চলছে সমালোচনা।
আরও পড়ুন: জনগণের ধাওয়া খেয়ে এমপির নাম হয়ে গেল ‘দৌড় সালাউদ্দিন’
জানা গেছে, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর এ দৌড়ের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে অনেকটাই অস্বস্তিতে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতারা। সরকার পতনের আন্দোলনে মাঠ থেকে টুকুর পলায়নপর দৃশ্য নিয়ে প্রকাশ্যে নানা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিলেও বিএনপির অন্দরমহলে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ১৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ভাইরালের পর দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অনেকেই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনীতিতে যুবদল সভাপতির সাহসিকতা ও দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তবে বিষয়টির ব্যাখ্যা এসেছে স্বয়ং সুলতান সালাউদ্দিন টুকু কাছ থেকেই। তার দাবি, পুলিশ বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। সেজন্য তারা সামান্য সরে গিয়ে এক সাইডে অবস্থান নেন এবং পরক্ষণেই পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোতে প্রথমবারের মত পুলিশের অনুমতি ছাড়া সরকারের পতনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। ওই কর্মসূচিতে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ছাড়াও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাকর্মী সমবেত হয়েছিলেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, সেখানে টুকু নেতাকর্মীদের নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন- ‘আমরা সবাই জিয়ার সেনা, ভয় করি না বুলেট-বোমা’। এরপর একটু আতঙ্কের দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়েই পেছনে থাকা নেতাকর্মীদের ভেদ করে দৌড় দেন তিনি। এসময় সেখানে থাকা অন্য নেতাকর্মীদেরও তার পেছন পেছন দৌড়াতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন: মাতুয়াইলে তিশা পরিবহনের বাসে আগুন
বর্তমানে যুবদল সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে তার এই পিছু হটার ঘটনা নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ নিয়ে কথা হয় যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মোরতাজুল করিম বাদরু ও মহানগর উত্তর বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঙ্গে। তবে তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। অন্যদিকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিকে ‘সুপার এডিটেড’ বলে দাবি করেছেন যুবদলের যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন আল মামুন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবদলের দায়িত্বশীল একজন নেতা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যারা সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঙ্গে গত দু-তিন দশক ধরে রাজনীতি করছি তারা তাকে ভালোভাবেই চিনি। বর্তমানে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে টুকু সবচেয়ে ভীতু। এটা আমরা যারা পাশাপাশি রাজনীতি করি সবাই জানি। অবস্থান কর্মসূচির দিন গণমাধ্যমের কল্যাণে এবার সেটা গোটা জাতি জেনেছে। নামে সুলতান এক পলকের দৌড়ে হয়ে গেলেন বিড়াল। ছাত্রদলের সভাপতি থাকাকালীনও তার ভীরুতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মার খেতে হয়েছে। দৌড় দেওয়া তার পুরোনো অভ্যাস। অতীতেও তিনি এভাবে দৌড়ে পালিয়ে নেতাকর্মীদের হামলার মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
যুবদল সভাপতির এ ‘দৌড়কাণ্ড’ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরিয়ে এনেছে প্রায় দেড় যুগ আগে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদের সেই দৌড়ের স্মৃতি। ২০০৬ সালের ৫ মে বিদ্যুৎ এবং পানির দাবিতে আন্দোলন চলাকালে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিরোধীদের ধাওয়ার মুখে পড়েন বিএনপির তৎকালীন ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) আসনের এমপি সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তোপের মুখে শনিরআখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত দৌড়ে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করেন তিনি। সেই থেকে বিএনপির এ নেতা ‘দৌড় সালাহ উদ্দিন’ নামে পরিচিত।
সালাহ উদ্দিনের সেই দৌড়কাণ্ডের প্রভাব পড়ে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সেবার ঢাকা-৪ সংসদীয় আসনটি বিভক্ত হলে নবগঠিত ঢাকা-৫ আসন থেকে নির্বাচন করেন সালাহ উদ্দিন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমান মোল্লার কাছে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অর্ধলক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সেবার একই ঘটনার ছাপ পড়ে ঢাকা-৪ আসনেও। বড় পরাজয়ে সেই আসনটিও হারাতে হয় বিএনপিকে। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ঢাকা-৪ সংসদীয় আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এমপি হয়েছিলেন কথিত ‘দৌড় সালাহ উদ্দিন’।
আরও পড়ুন: ধোলাইখালে পুলিশকে পেটালো বিএনপি কর্মীরা, মাথা ফাটলো এসআইয়ের
প্রায় একই কায়দায় এবার যুবদল সভাপতির পুলিশ দেখে দৌড় দেওয়ার ঘটনায় যুবদলের ওই দায়িত্বশীল নেতা আরও বলেন, ভীতু হলেও ‘বিশেষ কোটায়’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ছাত্রদল ও যুবদলের শীর্ষ নেতৃত্বে এসেছেন টুকু। এবার সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সংগঠনের মধ্যেই বলাবলি হচ্ছে, ‘দৌড় সালাহ উদ্দিনের পর, বিএনপিতে দৌড় টুকুর জন্ম। তিনি নামেই সুলতান কাজকর্মে বিড়াল...।’ এবারের ঘটনায় বিএনপির হাইকমান্ড তার ওপর বিরক্ত এবং সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বিব্রত।
সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা যুবদলের প্রচার সম্পাদক আব্দুল করিম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, এটি কোনো দৌড়ের দৃশ্য ছিল না। উনি পেছনের দিকে ব্যাক করেছেন, সবাই ব্যাক করেছেন। উনার সামনে তো আরও অনেক লোক ছিল, উনি মাঝখানে ছিলেন। সেখানে আব্বাস ভাই (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) তখন ছিলেন না। পুলিশ তার বাসা ঘিরে রেখেছিল। যে কারণে আব্বাস ভাই বের হতে পারেননি, যাননি। সেখানে প্রথম টুকু ভাই, জিলানী ভাই (স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানী) ও তানভীর আহমেদ রবিন (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব)সহ আমরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকি। ধীরে ধীরে সাধারণ জনতা জড়ো হতে থাকেন। টুকু ভাই দৌড় দেননি। তিনি পেছনে ব্যাক করে সাইড হয়ে পরে বেলা আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত মাঠেও ছিল। আমরা ততক্ষণ তার সঙ্গেই ছিলাম।
তিনি বলেন, রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে যে কোনো কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কারণ, যেভাবে রায়টকার স্পিডে আসছিল সবাই তো পেছনের দিকে দৌড় দিয়েছে। টুকু ভাই নিজেও বলেছেন, উনি কৌশলগত কারণে পেছনের দিকে সাইড নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়েছেন।
যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ অবশ্য টুকুর এ ভূমিকাকে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন।
আরও পড়ুন: মাতুয়াইলে আরও এক বাসে আগুন, পরিস্থিতি থমথমে
টুকু নিজে ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেছেন, আমি সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানেই (মাতুয়াইলে) অবস্থান করেছি। যখন পুলিশ গুলি করে, আমরা একটা সাইড নিয়েছি। একটা সাইডে পাল্টা অবস্থান নিয়ে হামলা মোকাবিলা করেছি। মাঠে যখন পুলিশ গুলি করে তখন একটা সাইড নিতে হয়, অবস্থান নিতে হয়। আমরা সেই অবস্থান নিয়েই পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমরা রাজপথে আছি, রাজপথে থাকবো। বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবো না।
তবে দৌড়ে পিছু হটাকে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল বলতে নারাজ টুকু। আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার প্রসঙ্গে যুবদল সভাপতি বলেন, গ্রেফতার করলে কর্মীদের মনোবল ভাঙে না, বরং গ্রেফতারের পর সহযোদ্ধাদের মুক্তির দাবিতে নেতাকর্মীরা আরও জোরালোভাবে মাঠে নামে।
তিনি বলেন, আমাদের পিছু হটার কোনো পথ নেই। এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে। ইনশাল্লাহ্, এ সরকারের পতন ঘটবে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন করছি, তাতে নেতাকর্মীদের যোগদান দিন দিন বাড়তেই থাকবে। সরকার পতনের এ জনস্রোত দীর্ঘায়িত হবে। জনস্রোতেই এ সরকারের পতন হবে।
যুবদল সভাপতি আরও বলেন, আমাদের ওপর হামলার পর নেতাকর্মীদের মনোবল আরও বেড়েছে। তারা যৌথভাবে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলা মোকাবিলা করেছে।
কেএইচ/এমকেআর/এএসএম