ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনে বিএনপির যত চ্যালেঞ্জ

খালিদ হোসেন
খালিদ হোসেন খালিদ হোসেন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৩২ পিএম, ১৫ জুন ২০২৩
বিএনপির সমাবেশ/ফাইল ফটো

সরকার পতনের আন্দোলনে গত ১৭ বছর কার্যত ব্যর্থ বিএনপি। অনেক হাঁকডাক দিয়েও জমাতে পারেনি কোনো আন্দোলন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দিলেও মাঠের আন্দোলন সেই অর্থে জমাতে পারেনি এখনো। ঈদুল আজহার পর চূড়ান্ত আন্দোলনের বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত। তবে কর্মসূচির সফলতা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আন্তর্জাতিক লবিং, ক্ষমতাসীনদের বাধা, হামলা-মামলা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, অন্তর্কোন্দল প্রভৃতি বিষয়কে আন্দোলনের সফলতার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন নেতাকর্মীরা।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিএনপির শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে হামলা চালাচ্ছে। মামলা-হামলা, গ্রেফতার, ন্যায্য জামিন না দেওয়া, কারাফটকেই আবার আটক করা- এসব তো আছেই। চূড়ান্ত কর্মসূচির মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ‘মরণ কামড়’ দেবে। এর বিপরীতে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া আন্তর্জাতিক মহল ও দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তিকেও চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অনেকে।

আরও পড়ুন>> ঈদের পর কি আন্দোলন আরও চাঙা করবে বিএনপি?

দলীয় সূত্র জানায়, ১৭ বছর পর বিএনপি সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। তবে এজন্য দলের যে ক্ষুরধার নেতৃত্ব দরকার, সেটার সংকট রয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাজার হাজার মাইল দূরে। কার্যত এই মুহূর্তে দলের কাণ্ডারি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার নেতৃত্ব কতটা প্রখর সেটা গত বছরের ৭ ডিসেম্বর দলীয় কার্যালয়ের সামনে যখন তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন ওই দৃশ্য থেকেই স্পষ্ট। তখন তার পাশে একমাত্র নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।

ভোগাতে পারে স্থায়ী কমিটির চার বলয়

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে চার বলয় রয়েছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান টুকু মিলে এক কোরাম। মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাউদ্দিন আহমেদ মিলে আরেক কোরাম। আব্দুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান সবার সঙ্গেই তাল দিয়ে চলেন। দলের এমন বিভাজনে নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস বিদ্যমান।

অঙ্গ, সহযোগী, বিভাগীয় সাংগঠনিক পদধারী নেতাদের মধ্যেও রয়েছে বিভাজন। একেকজন কেন্দ্রের একেকজন নেতার অনুসারী। আন্দোলন-সংগ্রামে যা প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।

অনেক ইউনিটে নেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি

আবার সারাদেশে দলের অনেক ইউনিটেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, এমন কিছু ইউনিটও আছে যেখানে কমিটির অস্তিত্ব নেই। এছাড়া আন্দোলনের জন্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর যে ধারালো নেতৃত্ব দরকার সেটাও অনুপস্থিত। একমাত্র জাতীয়তাবাদী যুবদল ছাড়া অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলো অগোছালো। দলের শূন্য পদগুলোতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাও নেতাকর্মীদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেননি।

আরও পড়ুন>> ঈদের পরেই এক দফার আন্দোলনে যেতে পারে বিএনপি

আরেকটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি দেশের প্রত্যেকটা থানায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। কেন্দ্র ঘোষিত এ কর্মসূচি পালনের চিত্র দেখে নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা।

জানা যায়, শাজাহানপুর থানা এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৬৫ জন লোকের উপস্থিতি ছিল। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাড়ির পাশের স্কুলমাঠে অনুষ্ঠিত ওই মানববন্ধন ঘণ্টাব্যাপী হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ১৫ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। অথচ এটা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু এবং জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্নারও এলাকা।

একটি সূত্র বলছে, দলের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি প্রতিপক্ষের কৌশল এবং পরিস্থিতিও কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। আন্দোলন সামনে রেখে রাজনৈতিক মামলা সক্রিয় হচ্ছে। এসব মামলায় যদি সাজা হয় তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রাজনীতির বাইরে ছিটকে পড়তে পারেন। এসব ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র এবং কম গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও ব্যবহার করতে পারে সরকার।

দলের মধ্যে উকিল সাত্তারের মতো নেতা ঘাপটি মেরে আছেন কি না, দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত, সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান কী হয় সেটাও ফ্যাক্ট। যারা যুগপৎ আন্দোলনে মিত্র হিসেবে রয়েছেন শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান কী থাকে সেটাও রাখতে হচ্ছে হিসাবে।

মার্কিন ভিসানীতি বিএনপির জন্যও চ্যালেঞ্জ। বিগত আন্দোলন-কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় তারা অভিযুক্ত। সেক্ষেত্রে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে থাকতে হচ্ছে সতর্ক।

ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনে বিএনপির যত চ্যালেঞ্জ

যা বলছেন নেতারা

গত নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে দলের পক্ষ থেকে প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া কৃষিবিদ পলাশ আগামী নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী। চূড়ান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামাটাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ। যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামতে পারে তাহলে সরকারের পতন হবে। দাবি আদায় হবে।

আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসানীতিতে শঙ্কা-সম্ভাবনার দোলাচলে বিএনপি!

রাজশাহী জেলা বিএনপির সদস্য, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন জাগো নিউজকে বলেন, এক দফা আন্দোলন ছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো পথ নেই। সরকার পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করবে- এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তবে শেষ মুহূর্তে পুলিশ প্রশাসনও সরকারের আজ্ঞাবহ থাকবে না।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক জাগো নিউজকে বলেন, চ্যালেঞ্জ বলতে আমি বুঝি, আমরা যে দাবি নিয়ে আছি এটা শুধু বিএনপির দাবি নয়, এটা গণমানুষের দাবি। সেই দাবি আদায়ে সরকারের বাধা থাকবে। সামনে যে বাধাই আসুক না কেন যে কোনোভাবে সেই বাধা ওভারকাম করতে হবে।

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান বলেন, বিগত ১৪ বছর ধরে আমরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের মনোবল ক্ষমতাসীনদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। সামনে যে চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, আমরা মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিজয়ী হবো।

নির্বাহী কমিটির সদস্য ওবায়দুল হক নাসির বলেন, আন্তর্জাতিক এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না। একমাত্র চ্যালেঞ্জ সরকারের আইনবহির্ভূতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন বলেন, সরকার মামলা-হামলা বাড়িয়ে দেবে। জনদুর্ভোগ তৈরি করবে, এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনে বিএনপির যত চ্যালেঞ্জ

যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে জনগণের আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করতে। কিন্তু এটা করে লাভ হবে না, এটা তাদের বোকামি হবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং দেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দলের অভ্যন্তরীণ সংকট আন্দোলনের জন্য চ্যালেঞ্জিং কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি জানি না দলে অভ্যন্তরীণ সংকট রয়েছে কি না। যেহেতু রাজনীতি, এটা থাকতে পারে। কিন্তু এখন বিএনপির যে দাবি এটা গণমানুষের দাবি হয়ে গেছে। আন্দোলন এখন কর্মীদের কাছে চলে গেছে, নেতাদের কাছে নেই।

ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, জনগণের আন্দোলনের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ না। জনগণের বিজয় হবে।

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. সুকমল বড়ুয়া বলেন, কিছু জিনিস প্রকাশ্য থাকে, কিছু জিনিস অপ্রকাশ্য। সব প্রকাশ করা যায় না। এটা নীতিনির্ধারকরা বলতে পারবেন।

স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, সরকার সহিংসতা করবে, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে, সহিংসতা করে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবে এবং এর বদনাম আমাদের ওপর দেওয়ার চেষ্টা করবে।

কেএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।