সুবিধায় জামায়াত!
গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি কাদা-ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। ভিসানীতি নিয়ে যখন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল দোষারোপের রাজনীতিতে ব্যস্ত তখন ‘বেশ সুবিধাজনক’ অবস্থায় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। দীর্ঘ এক দশক পর মাঠের রাজনীতিতে ফিরেছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
দলটির নেতারা বলছেন, জামায়াত এখন স্বাধীন! যে পরিস্থিতি তাতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সরাসরি পক্ষে না নিলেও কৌশলে ছাড় দিতে পারে। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে যদি জোট হয় সেক্ষেত্রে আসনভিত্তিক দরকষাকষিতে জামায়াতের শক্ত অবস্থান থাকবে। এককভাবে নির্বাচন করলেও সারাদেশে সাংগঠনিক যে ভিত্তি আর ভোটব্যাংক রয়েছে তাতে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হবে।
সূত্রমতে, গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মূলত জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির দূরত্ব বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপি জোট-রাজনীতি ভেঙে দেয়। পরে ২০ দলীয় জোটের ক্ষুদ্র দলগুলো অন্য জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও জামায়াতে ইসলামী কোনো জোটে না গিয়ে আগামী নির্বাচন টার্গেট করে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ১২০ এর অধিক আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে রাজপথ উত্তপ্ত হবে: তাহের
শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব হারানোর মধ্যদিয়ে জামায়াতের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দুর্বল হয়ে যায়। যারা নেতৃত্বে রয়েছেন তারা মনে করেন, বিএনপি যদি শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যায় তাহলে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণের ঘাটতি থাকবে। সে কারণেই তারা বিএনপির বাইরে অগ্রিম নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কোনো কারণে বা কোনো পরিস্থিতিতে যদি আগামী দিনে জোটের রাজনীতি করতে হয় তাহলে আসনভিত্তিক দরকষাকষিতে জামায়াত শক্ত অবস্থান নিতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে যদি কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা বা জোটগত নির্বাচন না হয় সেক্ষেত্রেও তাদের সাংগঠনিক শক্তি প্রমাণের জন্য এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। একটু সম্মানজনক পর্যায়ে যাওয়ার জন্য এককভাবে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেহেতু বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জামায়াতের ঐকমত্য এ মুহূর্তে নেই, সেদিক থেকে জামায়াত কিছুটা স্বাধীন। আগামী দিনে ঐকমত্য হওয়ার জন্য উভয়পক্ষের যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা সেটাতেও দুই দলের মধ্যেই টানাপোড়েন। নিকট অতীতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমীর খসরুসহ একাধিক নীতিনির্ধারক জামায়াতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখেছেন। সেদিক থেকে আগামী নির্বাচনে সরকার জামায়াতকে সরাসরি পক্ষে না নিলেও কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াতকে ‘ছাড়’ দিতে পারে। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে তেমন ইঙ্গিত মিলছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জামায়াত আমির শফিকুর রহমানসহ জাতীয় নেতা ও ওলামায়ে কেরামের মুক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে গত ৫ জুন ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করার অনুমতি চেয়ে প্রথমে ঢাকা মহানগর মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে আবেদন করে জামায়াত। কিন্তু অনুমতি মেলে না। ২৯ মে আবেদন নিয়ে আবারও ডিএমপিতে যান জামায়াত নেতারা। আবেদন নিয়ে ডিএমপি কার্যালয়ে গেলে আটক করা হয় জামায়াতের চার নেতাকে। যদিও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন>> জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে তাদের মুরুব্বি বিএনপি: কাদের
অনুমতি না মেলায় ৫ জুনের বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করে জামায়াতে ইসলামী। তবে ১০ জুন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে দুপুর ২টায় নতুন করে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের ঘোষণা দেয় দলটি। সেই কর্মসূচির অনুমতি চাইতে আবারও ডিএমপি কার্যালয়ে যায় দলটির একটি প্রতিনিধিদল। এবারও অনুমতি মেলে না। আবেদন না মঞ্জুরের পর অনুমতি ছাড়াই কর্মসূচি পালনের পাল্টা হুমকি দেয় জামায়াত। পরে আবারও জামায়াত নেতারা আবেদন নিয়ে ডিএমপি কার্যালয়ে যান। শেষমেশ ১০ জুন জামায়াতকে ইনডোরে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ। অনুমতি পেয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পালনের কথা বলা হয়। অন্যদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জামায়াতের প্রতি কড়া মনোভাব থাকলেও তাদের বক্তব্যে যথেষ্ট নমনীয়তা লক্ষ্য করা যায়।
শনিবার (১০ জুন) দুপুর ২টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জামায়াতের সমাবেশ শুরু হয়। দীর্ঘ এক দশক পর ঘরোয়াভাবে সমাবেশ পালন করে জামায়াত। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাইরের খোলা জায়গা এবং ফুটপাতে অসংখ্য নেতাকর্মী জড়ো হন। একপর্যায়ে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি মূল সড়কে গিয়ে ঠেকে। এতে মৎস্য ভবন ক্রসিং থেকে শাহবাগ অভিমুখী সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নেতাকর্মীরা জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন। বক্তব্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামী সংগীত পরিবেশন ও কবিতা আবৃত্তি করা হয়। সমাবেশ ঘিরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়।
আরও পড়ুন>> বিএনপির ‘ভুল’ ভাঙার অপেক্ষায় জামায়াত
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত নিরপেক্ষ সরকার। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে হবে। দাবি না মানলে রাজপথ উত্তপ্ত হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন করে জনগণের দাবি মেনে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান নির্বাচন। সেটা হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। সেটা করতে হলে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করতে হবে। কিন্তু এরা (আওয়ামী লীগের প্রতি ইঙ্গিত করে) দিনের ভোট রাতে করে। লজ্জা তো ঈমানের অঙ্গ। কিছুটা তো লজ্জা থাকা উচিত নেতাদের। সুতরাং বলবো, ২০১৪ ও ২০১৮ গেছে যাক। এবার ২০২৪ আর সেভাবে যাবে না। এটা যদি আওয়ামী লীগ বুঝে তাহলে বলবো- আসুন, আলোচনা করুন। এবারের নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে দাবি আদায়ে যা করা দরকার আমরা তা করবো, ইনশাআল্লাহ্।’
নির্বাচনের এখনো প্রায় ছয়-সাত মাস বাকি। কিন্তু আগে থেকেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন নিয়ে তৎপর। কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন ও নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার প্রয়াস। নির্বাচনের আগেই শতাধিক আসনে নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর মনিরামপুর উপজেলার সাবেক আমির যশোর জেলা শাখার শিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন না, আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছি।’
তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জোটগত নাকি এককভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই জোটগত ইলেকশন হলে ভালো হবে।’
আরও পড়ুন>> অনুমতি ছাড়াই মিছিল-সমাবেশের ঘোষণা জামায়াতের: পুলিশের কড়া হুঁশিয়ারি
জোট আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাকি বিএনপির সঙ্গে? জবাবে ফজলুল হক বলেন, ‘অবশ্যই বিএনপির সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক আছে। নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাদের চেয়ারপারসন কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রবাসে। যারা দায়িত্বে আছেন তারা সেভাবে আমাদের মূল্যায়ন করেন না। জাতীয় পার্টির সারাদেশে ভোট নেই। তারপরও জাতীয় পার্টিকে সরকার গত ১৫ বছর যেভাবে লালন পালন করেছে, সে তুলনায় আমাদের সারাদেশের সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে, ভোটব্যাংক আছে। যেহেতু আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই ,আমরা জানি আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নেতাকর্মীরা বিএনপির সঙ্গেই জোট করতে চান।’
সেক্ষেত্রে বিএনপির কাছে এবার কতগুলো আসন চাইবেন? জবাবে ফজলুল হক বলেন, ‘অবশ্যই ৫০ এর অধিক, ন্যূনতম ৫০ আসন।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের আসনভিত্তিক কাজ চলছে।’
দলের নেতাকর্মীরা জোটগত নির্বাচন চাইছেন, নাকি এককভাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘নেতাকর্মীরা চান জোটগত নির্বাচন।’
আরও পড়ুন>> কর্মসূচির অনুমতি নিতে গিয়ে ডিএমপিতে আটক ৪ জামায়াত নেতা
কোন দলের সঙ্গে জোট, আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি? জবাবে আজিজুর রহমান বলেন, ‘সে ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে কিছু বলেনি।’
নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে অংশ নেবে জামায়াত। সেজন্য জামায়াতের প্রস্তুতি থাকবে সেটি স্বাভাবিক।’
‘তবে, দেশের মানুষ যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই অবস্থা ফিরিয়ে আনা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জামায়াতে ইসলামী এখন ভোটের চিন্তার থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’ যোগ করেন তিনি।
জামায়াত আমির বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায়ের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জোটবদ্ধভাবে ভোট করার চিন্তা করবো আমরা।’
কেএইচ/ইএ/জেআইএম