আন্দোলন চাঙা রাখতে এবার বিএনপির ‘ইফতার কূটনীতি’
আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন কেন্দ্র করে নানান দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে বিএনপি। যদিও কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ ছাড়া খুব বড় কোনো কর্মসূচিতে এখনো যেতে পারেনি দলটি। মাঠের রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় হলেও জোটগত যুগপৎ আন্দোলন দৃশ্যমান কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। সরকার পতনের আন্দোলন সীমাবদ্ধ রয়েছে বক্তব্যের মধ্যেই। আসন্ন রমজানে ইফতার কেন্দ্র করে ভিন্ন ধাঁচে কূটনৈতিক তৎপরতার ছক কষছে দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, করোনা মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে ঘরোয়া রাজনীতির অংশ হিসেবে এবার ইফতারকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। রমজানে ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাবে দলটি। দলের পক্ষ থেকে এবার কমপক্ষে ছয়টি ইফতার পার্টির আয়োজন করা হবে। প্রথম রমজানে এতিম ও আলেম-ওলামাদের সম্মানে হবে ইফতার। এরপর পেশাজীবী, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কূটনীতিকদের সম্মানে আয়োজন থাকবে। নির্বাচনের আগে ইফতার পার্টি ঘিরে কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায় বিএনপি।
আরও পড়ুন>> আরও একটি ঈদ গেলো, বিএনপির আন্দোলন কতদূর
এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, জাতীয়তাবাদী যুবদল, কৃষক দল, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (ড্যাব) দল সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও ইফতারের আয়োজন করা হবে। এক দফার আন্দোলন সামনে রেখে নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়েও ইফতার পার্টির আয়োজনের চিন্তা-ভাবনা করছে দলটি।
জানা যায়, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদল ও জোটগুলো এরই মধ্যে ইফতার পার্টি আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অতীতে এসব সমমনা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ইফতার পার্টির আয়োজনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অংশ নিতেন। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান তিনি। পরে পরিবারের আবেদনে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পর থেকেই তিনি গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায় রয়েছেন এবং দলের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। তাই প্রায় সবাই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রধান অতিথি করতে চান। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও এসব ইফতারে উপস্থিত থাকবেন।
আরও পড়ুন>> যুগপৎ আন্দোলনে তৃণমূলের ঐক্যে মনোযোগী বিএনপি
সূত্র জানায়, গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) পক্ষ থেকে আলাদা অথবা যৌথভাবেও ইফতার আয়োজন করা হতে পারে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) পক্ষ থেকেও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হবে। গণতন্ত্র মঞ্চ জোটগতভাবে একটি ইফতার মাহফিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনো দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। সেখানে জামায়াত ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দলকেই আমন্ত্রণ জানাবে তারা। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, এবার রমজানে বিএনপির পক্ষ থেকে কয়েকটি ইফতার আয়োজনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম রোজায় রাজধানীর লেডিস ক্লাবে এতিম ও আলেম-ওলামাদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করা হবে। তবে পেশাজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতারের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির শরিক তিনটি জোটের (গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট) পক্ষ থেকেও এবার ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
আরও পড়ুন>> বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য ২৭ দফা
যে কোনো ঈদ এলেই বিএনপির আন্দোলনের ঘোষণার জোর বাড়ে। কিন্তু জোরালো হয় না আন্দোলন। সেই ২০১৪ সালের ২২ জুন বিকেলে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে জয়পুরহাটে এক জনসভায় ঈদের পরে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সে বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করার পর তৃতীয়বারের মতো ঢাকার বাইরে জনসভায় দেওয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, ঈদের পর আন্দোলন শুরু করবো। দুর্নীতিবাজ সরকারকে বিদায় করবো। আন্দোলনের জন্য আপনারা প্রস্তুত হন।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি বলতে হরতাল-অবরোধ পরিচিত। ২০১৪ সালে দেশে ২২টি হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে সাতটি ডাকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ২০১৫ সালের প্রথম দিনটি ছিল জামায়াতের হরতাল। ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণা করে নেতারা আত্মগোপনে যাওয়ায় এক পর্যায়ে ঘোষণা ছাড়াই শেষ হয় সে অবরোধ।
আরও পড়ুন>> ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে ‘কৌশলী’ বিএনপি
নয় বছর আগে দলীয় প্রধানের ওই বক্তব্যের রেশ ধরে ঈদ সামনে রেখে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এখনো এ ধরনের বক্তব্য দেন। ঈদ যায় ঈদ আসে কিন্তু সেই অর্থে কোনো কঠোর আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ফলে বিরোধী শিবির থেকে নিয়মিত কটাক্ষ শুনতে হয় দলের নেতাকর্মীদের।
এবার রমজান টার্গেট করে ইফতার আয়োজনে আগেভাগে তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে দলের মধ্যে। আন্দোলনের বিষয়ে সিনিয়র নেতারা আপসহীন বক্তব্য দিচ্ছেন। ইফতার কেন্দ্র করে শুধু কূটনৈতিক তৎপরতা নয়, নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত ও আন্দোলন চলমান রাখার কথা বলছেন তারা। বরাবরের মতো রমজান শেষে ঈদের পর স্পষ্ট হবে আন্দোলনের প্রকৃত গতিপথ।
বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জাগো নিউজকে বলেন, রমজান মাসে ঘরোয়া কর্মসূচি থাকবে, সাংগঠনিক কার্যক্রম চলবে, ইফতার মাহফিলও হবে। এর বাইরে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী রাস্তার কর্মসূচিও থাকতে পারে। আমরা আন্দোলনের মধ্যে রয়েছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, বিএনপি দেশ রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে। এ আন্দোলন রোজার মধ্যে বন্ধ থাকার কোনো কারণ নেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবন চলমান থাকে। আমাদের আন্দোলনও চলমান থাকবে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে এ রমজানে আরও কঠিন কর্মসূচিও আসতে পারে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করেই চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এ সরকারকে জনগণ আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
রমজানে আন্দোলন-কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রমজানে ইফতার পার্টির পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, চূড়ান্ত আন্দোলন ঘোষণা দিয়ে আসে না। আজ থেকে দেড় বছর আগেও জনগণ ফ্যাসিস্ট সরকারের ভয়ে রাজপথে নামেনি। কিন্তু এ ভয় এখন আর নেই। জনগণ মৃত্যুকে জয় করতে শিখেছে। এরই মধ্যে গত ছয় মাসে এ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ১৭ জন নিহত হয়েছে। গণতন্ত্র মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
কেএইচ/এএসএ/জিকেএস