জোট রাজনীতিতে বিএনপি লাভবান না ক্ষতিগ্রস্ত?
প্রায় দুই যুগের বেশি সময় পর জোট রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি। তাদের লক্ষ্য এখন যুগপৎ আন্দোলন। দীর্ঘ সময় পর কেন জোট ছাড়লো বিএনপি? সামনে আসছে লাভ-ক্ষতির নানান হিসাব। দলটির একাংশের নেতারা মনে করছেন, জোট রাজনীতির ফলে বিএনপির ক্ষতি হয়েছে বেশি, শরিকরা লাভবান। তবে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা মনে করছেন, জোট রাজনীতিতে বিএনপির অসুবিধা হয়নি। বিএনপি অতীতেও শরিকদের সহযোগিতা পেয়েছে, এখনো পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আবারও জোট হতে পারে।
জানা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। যুগপৎ আন্দোলনে সেসময় এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯৭ সালে বিএনপি, জামায়াতসহ সাতদলীয় জোট গঠন করে জোট রাজনীতি শুরু করে বিএনপি। ১৯৯৯ সালে সাতদলীয় জোট বিলুপ্ত করে বিএনপি, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াত, অবিভক্ত ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট।
আরও পড়ুন>> বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল, যা ভাবছেন মিত্ররা
২০০১ সালে নির্বাচনের কিছুদিন আগে এরশাদ চারদলীয় জোট ত্যাগ করলে জাপার তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুসহ একটি অংশ রয়ে যায় এ জোটে। পরে এ জোট ক্ষমতায় এলে চারদলীয় জোট সরকার নামেই প্রতিষ্ঠা পায় বিএনপির শাসনামলে।
২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত ছিল। আরেক শরিক ইসলামী ঐক্যজোট কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে ক্ষমতার ভাগ পাওয়া চারদলীয় জোট।
পরবর্তীসময়ে চারদলকে সঙ্গে রেখেই ২০১২ সালে গঠিত হয় ১৮ দলীয় জোট। পরে জাপা (জাফর) এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলকে নিয়ে করা হয় ২০ দলীয় জোট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিয়ে বিএনপি গঠন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ ফ্রন্ট গঠিত হলে গুরুত্বহীন হয়ে যায় ২০ দলীয় জোট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এর পর বেশ কয়েকটি দল জোট ত্যাগ করে।
আরও পড়ুন>> বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উচ্ছ্বাস, তৃণমূলে অবিশ্বাস!
গত ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে হঠাৎ করেই ২০ দলীয় জোট বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বিএনপি এককভাবে চলার ঘোষণা দেয়। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৮ আগস্ট জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া দলগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিলুপ্ত করা হয় দুই দশকের রাজপথে বিএনপির পাশে থাকা ২০ দলীয় জোট।
আরও পড়ুন>>সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-গণতন্ত্র মঞ্চ
গত ২৪ বছরে জোট রাজনীতি থেকে বিএনপির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা হয় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে। পল্টন থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফিরোজ আলম পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, জোট রাজনীতির কারণে দল বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মনে হতো আমরা অনেকটা জোটের ওপর নির্ভরশীল। তবে এখন যে যুগপৎ আন্দোলন চলছে এটা ভালো সিদ্ধান্ত।
নোয়াখালী-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী, দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ জাগো নিউজকে বলেন, জোট রাজনীতি করতে গিয়ে বিএনপি যতটা লাভবান হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে বিএনপির শরিকরা বেশি লাভবান হয়েছে। এমপি-মন্ত্রী বাগিয়ে নিয়েছেন তারা। শরিকদের অবদানের চেয়েও অর্জন ছিল বেশি। কতিপয় শরিকের কিছু কর্মকাণ্ডে বিএনপিকে দেশ-বিদেশে বিব্রত হতে হয়েছে।
বাগেরহাট-৪ আসনের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, জোট রাজনীতির ফলে আমাদের এই আসনে সাধারণত জামায়াতের প্রার্থী মনোনয়ন পায়। দু-তিনবার জামায়াতের এমপি ছিল এ আসন থেকে। অথচ তাদের চেয়ে বিএনপির সংগঠন এখানে শক্তিশালী।
আরও পড়ুন>> রাজপথে শক্তি বাড়ছে বিএনপির?
‘জামায়াত নেতারা মনোনয়ন পাওয়ার ফলে তারা এমপি হয়েছেন এবং এমপি হওয়ার কারণে আমাদের বিএনপি নেতাকর্মীরা কেউ জামায়াতমুখী কেউ বা সংগঠনবিমুখ হয়েছে। জোট রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কারণে এখন যেসব আসনে জোট সঙ্গীরা প্রার্থী, এমপি হয়েছেন সেসব আসনে বিএনপি নেতাকর্মীরা আরও শক্তিশালী হবে।’
এই মতের সঙ্গে ভিন্নমতও পোষণ করেছেন অনেক নেতা। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, জোট রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতি আস্থা রেখেছে। বিএনপি বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সর্ববৃহৎ উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে। পাশাপাশি জামায়াতের কতিপয় নেতার যুদ্ধাপরাধ-জঙ্গিবাদের দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে বিএনপির ওপর।
‘বিএনপির বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এখন আমরা জোট থেকে বের হয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে যুগপৎ আন্দোলনে আছি। সব দেশপ্রেমিক শক্তি, দেশপ্রেমিক জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই সরকারের পতন ঘটিয়ে দাবি আদায় করবো।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সুবিধা-অসুবিধা দুটোই ছিল। স্বাধীনতার পর এমন ফ্যাসিবাদী সরকার আসেনি। টানা তিন দফা ক্ষমতায় থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে। নেতাকর্মীরা বাঁচার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই থেকে চিন্তা করলাম আমাদের জোট প্রয়োজন নেই।
‘আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের সামনে উত্থাপন করেছি, সাধারণ জনগণকে আমরা সহজেই পেয়ে যাচ্ছি কোনো জোট ছাড়াই। বরং জোটের প্রশ্নে আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী ও সমর্থকদের মধ্য থেকে অনেক সময় প্রশ্ন করে। এখন আমরা নিজেদের শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে জোট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগে হয়তো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন ছিল, তাই জোট হয়েছে। এখন জোটের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।’
তিনি বলেন, জোট রাজনীতির সুবিধা ও অসুবিধা অনেক। তাৎক্ষণিকভাবে বলা যায় চারদলীয় জোট সরকারের সময় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে বারবার বলা হতো। ইসলামপন্থি বিশাল কর্মী বাহিনী পেয়েছিলাম। দেশে যখন জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলো, ধ্বংসাত্মক তৎপরতা শুরু হলো তখন সেটার দায় আমাদের জোটসঙ্গীর ওপর এসে পড়ে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা জোটসঙ্গীদের লেভেল এঁটে দেওয়াও হয়েছিল।’
জোট রাজনীতিতে বিএনপির লাভ-ক্ষতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি এখন বড় কথা নয়। রাজনীতিতে সব সময় চ্যালেঞ্জ থাকে। সেটা একক রাজনীতিই হোক কিংবা জোট রাজনীতি হোক। একেক সময় চ্যালেঞ্জ একেক রকম। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তখনকার বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। রাজনীতি বুদ্ধির খেলা, সেই খেলার কৌশলে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি।
জোটের ভালো দিকটাই দেখছেন সেলিমা রহমান কিংবা খন্দকার মোশাররফের মতো শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, দীর্ঘদিনের এই জোটের রাজনীতিকে এক বাক্যে সফলতা-বর্থ্যতা মূল্যায়ন করা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না। তবে শুরুতেই আমাদের জোট গঠন হয়েছে ঐক্যের জন্য, সেই ঐক্য গড়তে আমরা সফল হয়েছি- এটুকু বলতেই পারি। সেই ঐক্যতে ২০০১ সালে সরকার গঠনও করেছি।
তাহলে ব্যর্থতা বা ক্ষতি কোনগুলো ছিল জোটের রাজনীতিতে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ক্ষতি বা ব্যর্থতা আমরা সেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করিনি, আর বিশ্লেষণ করলেও তা জনসম্মুখে বলা তো যাবে না।
তখন জোট বিএনপিকে ঐক্য এনে দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, তাহলে এখন কেন জোট ভেঙে দিলেন? এটা কি বিএনপির ক্ষতি হতে পারে না? এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিমা রহমান বলেন, তখনকার জোট ছিল নির্বাচনী জোট, কিন্তু বর্তমান সরকার ২০১৪ ও ১৮ সালে দেশে সেই নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দিয়েছে। তাই এখন নির্বাচনী জোটের প্রয়োজন নেই। এখন চলছে জনগণের ঐক্যের জন্য যুগপৎ আন্দোলন। এটা নির্বাচনী যুগপৎ আন্দোলন নয়, তবে বিএনপি ভবিষ্যতে প্রয়োজন মনে করলে অতীতের মতো নির্বাচনী জোট করতেও পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জোট রাজনীতিতে অসুবিধা হয়নি, বরং সুবিধা হয়েছে। বহু মতাদর্শের রাজনৈতিক দল এক প্ল্যাটফর্মে একীভূত হয়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আমরা জোটসঙ্গীদের সহযোগিতা পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি। আগামীতে আমরা সরকার গঠন করলে আমাদের যারা জোটসঙ্গী ছিল এবং এখন যারা আন্দোলন করছে সবাইকে নিয়েই আমরা সরকার গঠন করবো।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, জোট রাজনীতিতে বিএনপির লাভ-ক্ষতির হিসাবের ব্যালেন্স টানতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কারণ তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। জোট হচ্ছে ভোটের কারণে। ২০০১ সালে জোট করে তারা সরকার গঠন করেছে। জামায়াতের সঙ্গে জোট করার কারণে যেমন তারা জামায়াতের ভোট পেয়েছে তেমনি সরকারেও জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের জায়গা দিতে হয়েছে। এর জন্য বিএনপিকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন আসনে জোটসঙ্গীদের মনোনয়ন দিতে গিয়ে দলের ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট করে লাভবান হয়েছে, তবে সাংগঠনিকভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি-জামায়াত যদি জোট করতো তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতো না। বিএনপি আর জামায়াত যদি এক হয় তাহলে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভোট অনেক বেশি হয়। কিন্তু পরবর্তীসময়ে দেখা গেলো নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে সেই জোট বিলুপ্তি না করে বিএনপি সেটাকে ১৮ দল, পরবর্তীসময়ে ২০ দলে নিয়ে গেলো। এর মাধ্যমে বিএনপি জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়েছিল। গত নির্বাচনে জোটের কিছু নামসর্বস্ব নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে সাংগঠনিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
জেএইচ/জিকেএস