১০ ডিসেম্বর ঘিরে জনমনে শঙ্কা-ভীতি
আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিভাগীয় সমাবেশ করবে বিএনপি। এরই মধ্যে এই সমাবেশ নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও অন্যতম বিরোধীদল বিএনপির নেতারা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু করেছেন। এ অবস্থায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে জনমনে শঙ্কা ও ভীতির সঞ্চার হয়েছে। যদিও সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিত এড়াতে ও নগরবাসীর নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এরপরও ১০ ডিসেম্বর ঘিরে জনমনে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। বড় ধরনের কোনো ঘটনার শঙ্কার কথা উড়িয়ে দিলেও ওইদিন গণপরিবহন বন্ধসহ নানা সমস্যার আশঙ্কা করছেন নগরবাসী।
বেশ কিছুদিন ধরেই সাধারণ মানুষের আলোচনায় রয়েছে ১০ ডিসেম্বর। ওইদিন ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ। ওই কর্মসূচি সম্পর্কে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঢাকায় আমাদের বিভাগীয় পর্যায়ের শেষ সমাবেশ। এখানে আমরা সব দল মিলে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সামনে নিয়ে আসব। তবে দিনটিকে ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা। অরাজকতার চেষ্টা করলে ওইদিন শক্ত হাতে বিএনপিকে দমন করার কথাও বলছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
সেদিন কী হবে, তা নিয়ে কৌতূহল যেমন রয়েছে, তা ছাপিয়ে উঠেছে উদ্বেগ।
সমাবেশের দিন রাজধানীতে বাস চলবে কি না জানতে চাইলে মিরপুর-মতিঝিল রুটের বিকল্প অটো বাস সার্ভিস লিমিটেডের চালকের সহকারী কাম টিকিট চেকার তৌফিক ইমাম সোমবার (৫ ডিসেম্বর) জাগো নিউজকে বলেন, ‘‘১০ তারিখ কীভাবে গাড়ি চলবে? ওইদিন তো মারামারি চলবো। খেলা হবে নাহ? আপনি শুনেন নাই, ‘আসেন খেলা হবে’।’’
আরও পড়ুন: বিএনপির ‘ডেডলাইন ১০ ডিসেম্বর’ ঘিরে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
তিনি বলেন, ‘৯ তারিখ থেকেই গাড়ি বন্ধ থাকবে। মানুষের যাতায়াতের কষ্ট কি সরকার দেখবে?’
শিকড় পরিবহনের চালকের সহকারী মিলন কাউসার বলেন, ‘পরিবহন নেতারা এখনো কিছু বলেননি। ঝামেলার আশঙ্কায় অনেকে গাড়ি নামাবে না। ঢাকা সিটিতে তো গাড়ি বন্ধের মতো ওইরকম কিছু (নির্দেশনা) আসবে না বলে মনে হয়।’
মিলন বলেন, ‘‘মনে হয় না ঢাকায় ধর্মঘট দেবে। ঝামেলা হবে কি না এটা আসলে রাজনীতিবিদরা বলতে পারবেন। আমরা তো ভাই ‘পেটনীতিবিদ’। বড় কোনো ঝামেলা হবে না।’’
ইন্টারপ্রেটারের (অনুবাদের কাজ) কাজ করতে ফেনী থেকে ঢাকায় এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যাওয়াদ করিম। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে তার মধ্যেও উদ্বেগ কাজ করছে বলে জানান।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সাধারণত সায়েদাবাদ থেকে ভোর ৫টার গাড়িতে ওঠে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ফেনীতে পৌঁছাতে পারি। ১০ তারিখ যেতে পারবো কি না সেটা এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছি না।’
আরও পড়ুন: কী হতে চলেছে ১০ ডিসেম্বর?
তিনি বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেবে। পাশাপাশি সেখানে যেন লোকসমাগম কম হয় সেই ব্যবস্থাও করবে। ওইদিন সকালে অফিসের কাজে যেতে পারবো কি না তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
রাজধানীর মিরপুর আইডিয়াল স্কুলের সামনে কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে।
সমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, এখন স্কুলে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। এই সময় বড় কোনো ঝামেলা হলে শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়বে।
ব্যবসায়ী নাসির ইসলামের স্কুলপড়ুয়া মেয়ের পরীক্ষা চলছে। ১০ ডিসেম্বরও পরীক্ষা রয়েছে। ওইদিনের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হলে এর দায় রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। করোনার কারণে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে আছে।’
সমাবেশ নিয়ে কথা হয় একাধিক রিকশাচালকের সঙ্গে। দিনটি ঘিরে উদ্বেগ রয়েছে তাদের মধ্যেও।
পল্টন মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক ফারুক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওইদিন গ্যাঞ্জাম (ঝামেলা) হলে তো সমস্যা। দেখা যাবে মেইন রোডে রিকশা নামতে দেবে না। আমাদের তো রিকশার জমা খরচ ফিক্সড। রাস্তায় নামলেও ১২০ টাকা দিতে হবে, না নামলেও তা দিতে হবে। না নামতে পারলে টাকা কোথা থেকে এনে দেব? রিকশা বন্ধ থাকলে পেট চালানোই কঠিন হবে।’
আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বর বিএনপির খুব প্রিয় তারিখ: প্রধানমন্ত্রী
রোকন নামের আরেক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় শান্তিনগরে। তিনি বলেন, ‘জানি ১০ তারিখ বিএনপির সমাবেশ। ওইদিন কী হবে জানি না। ঝামেলা হলে হয়তো ওইদিন রিকশা বের করা যাবে না। অলিগলিতে চালাতে হবে।’
বিএনপির সমাবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন নয়াপল্টনের ব্যবসায়ীরাও। গাড়ির পার্টসের ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘দুই দলের নেতাকর্মীদের কথাবার্তা টিভিতে দেখছি। ১০ তারিখের আগে পরে কয়েকদিন দোকান বন্ধ রাখা লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক টাকার ক্ষতি হবে। এমনিতে এখন এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আনাগোনা বেড়েছে। এতে ক্রেতাও কমে গেছে।’
এদিকে নেতাদের তর্জন-গর্জনে আগামী ১০ ডিসেম্বর হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে দুই দশক আগে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিলের ‘ট্রাম্প কার্ডের’ স্মৃতি।
আওয়ামী লীগ ২০০৪ সালে বিরোধী দলে ছিল। দলটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ওই বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে আকস্মিক ঘোষণা দেন, ৩০ এপ্রিল ‘ট্রাম্প কার্ড’ ছাড়বেন তিনি, সেদিন ঘটবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন।
তার সেই ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গন ছাপিয়ে সারাদেশেই তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে ৩০ এপ্রিল পেরিয়ে গেলেও তেমন কিছু ঘটেনি দেশে।
একইভাবে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে চলছে নেতাদের কথার লড়াই। সেদিনের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়, এমন কথাও বলছেন বিএনপির নেতারা।
আরও পড়ুন: খেলা হবে, প্রস্তুত হয়ে যান: নেতাকর্মীদের ওবায়দুল কাদের
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি সমাবেশের নামে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন ঢাকায় এনে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। যেকোনো অস্থিরতা ঠেকাতে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
গত শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা (বিএনপি) জানান দিল সন্ত্রাস করবে, আবারও আগুন সন্ত্রাস ফিরে আসছে। খেলা হবে।’
কর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারা দেবে নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্যাম্পাসে, সারাদেশে, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড সব জায়গায় সতর্ক পাহারা থাকবে।’
এসএম/ইএ/এএসএম