নোয়াখালী-৪
গ্রুপিং-দ্বন্দ্বে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ, শক্ত ভিত একাট্টা বিএনপির
# আওয়ামী লীগে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি
# শক্ত ভিত বিএনপির, আছে আন্দোলনের মুডে
সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের ২৭১ নম্বর আসন নোয়াখালী-৪। স্থানীয় এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, পার্সেন্টেজ গ্রহণ, বেফাঁস মন্তব্য এবং দলে একক আধিপত্য বিস্তার করে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ নানা কর্মকাণ্ডে জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত আসন এটি। সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারিয়ে একরামের সাম্রাজ্যে ভাটা পড়েছে। তৈরি হয়েছে বিপক্ষ বলয়। সাম্রাজ্য টেকাতে মরিয়া এমপি গ্রুপ, দখলে নিতে সক্রিয় এন্টি এমপি গ্রুপ। আওয়ামী লীগের এই মুখোমুখি অবস্থানে ভোটের মাঠে সুখের ঘুম বিরোধী শিবিরে। একক প্রার্থী, ঐক্য, দীর্ঘদিনের জনসমর্থন এবং ক্ষমতাসীনদের বিভাজনই এখানে বিএনপির বড় শক্তি।
এ অবস্থায় নোয়াখালী-৪ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। অন্যদিকে বিএনপি আছে আন্দোলনের মুডে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘এখনো তো নিশ্চিত নয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে হবেন! প্রার্থিতার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও আমেজ। তবে আওয়ামী লীগে একটা বড় অংশ পরিবর্তন চায়।’ ভোটাররা বলছেন, ‘এখানে নির্বাচন জোয়ারে চলে। যখন যে দলের জোয়ার সেই পাস করে।’
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও এলাকার অবস্থা দেখতে সম্প্রতি নোয়াখালী সফর করে জাগো নিউজ টিম। গত ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসের কর্মসূচি নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ব্যস্ত থাকলেও নোয়াখালী এসে চোখে পড়ে ভিন্ন চিত্র। দেখা যায়, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ঘিরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দুই পক্ষ। এলাকা বেশ থমথমে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের টেন্ডার ড্রপ নিয়ে এ অবস্থান। একটি পক্ষ এমপি গ্রুপ, আরেকটি পক্ষ পৌর মেয়র সহিদুল্যাহ খান সোহেলের গ্রুপ।
স্থানীয়রা বলছেন, আগে এ অবস্থা ছিল না। এককভাবে এমপির নিয়ন্ত্রণ ছিল। এমপির ইশারায় চলতো সব। এমপির মনোনীত প্রতিনিধিরাই করতেন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্যসহ এলাকার সবকিছু। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিহাব উদ্দিন শাহীন, পৌর মেয়র সহিদুল্যাহ খান সোহেল, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ পিন্টুসহ অনেকেই ছিলেন এমপির ‘খলিফা’। তাদের মাধ্যমেই চলতো সব। এখন এরা নেই এমপির সঙ্গে। জেলা আওয়ামী লীগের নয়া কমিটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নতুন বলয়। এরই প্রভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে। তারা কেউ একরামের সঙ্গে আছেন, কেউ নয়া জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে।
দৃশ্যত এখন একরাম চৌধুরীর সঙ্গে আছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুদ্দিন (জেহান)। এছাড়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম, দুই যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব উদ্দিন শাহীন ও সহিদুল্যাহ খান সোহেল, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টুসহ অন্য নেতারা একসঙ্গে। অবশ্য এর ভেতরেও মনোনয়নের বিষয়ে আলাদা প্রত্যাশা আছে অনেকের।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৪ আসনে বর্তমান এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর বাইরে এখানে প্রার্থী হতে পারেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম, যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব উদ্দিন শাহীন ও সহিদুল্যাহ খান সোহেল।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক উকিলের ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন লাতুও এখানকার প্রার্থী। তিনি দলের দুঃসময়ে (১৯৯১ ও ২০০১) নৌকা নিয়ে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি ও সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতার জন্য এবার সাবেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত ছাত্রনেতাদের থেকে নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে নোয়াখালী-৪ আসনে আলোচনায় আছেন ২০০১ পরবর্তী দুঃসময়ের কারানির্যাতিত ছাত্রনেতা, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সাবেক গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু।
এখানে মনোনয়ন চান মহাজোটের শরিক বিকল্পধারা মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান। আওয়ামী লীগের গ্রুপিং এবং চরম দ্বন্দ্বের এই আসনে তুরুপের তাস হতে পারেন তিনিও।
অন্যদিকে বিএনপির একক প্রার্থী চারবারের এমপি ও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান।
আওয়ামী লীগে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি
নোয়াখালী-৪ আসনে প্রার্থীর পরিবর্তন চান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের অভিযোগ, একরাম চৌধুরী জেলা সংগঠনের পাশাপাশি নোয়াখালী-৪ তথা সদর ও সুবর্ণচরেও আওয়ামী লীগের ব্যাপক ক্ষতি করেছেন। টেন্ডার-নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানান কর্মকাণ্ডে একটা নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকায় ভোট বাড়ার কথা থাকলেও উল্টে কমেছে। এজন্য যেভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে এই আসন থেকেও সরিয়ে দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে যে কোনো নেতাকে মনোনয়ন দিলে তারা পাস করিয়ে আনবেন।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব উদ্দিন শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, নোয়াখালী-৪ আসনে যিনি আছেন, তার বাড়ি কিন্তু এখানে না। তিনি আরেক উপজেলার বাসিন্দা। যাই হোক আমরা দলের প্রতি আস্থাশীল, নেত্রী যাকে দিয়েছেন আমরা মেনে নিয়েছি। যেহেতু তার বাড়ি এখানে নয়, পাশাপাশি তার বিভিন্ন অপকর্ম, সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপ, বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড; বিশেষ করে আপনারা দেখেছেন- টেন্ডারবাজি, নিয়োগসহ অনেক বিষয়ে অভিযোগ এসেছে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। এ কারণে তৃণমূলের দাবি হচ্ছে, নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচরের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দিক। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ও নোয়াখালী মানুষের অভিভাবক ওবায়দুল কাদের এই দুই উপজেলা থেকে যাকেই মনোনয়ন দেবেন, আমরা পাস করিয়ে আনবো কথা দিলাম।
তিনি বলেন, বিগত জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিকই ছিল- একরাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক। তিনি তার ব্যক্তিচর্চার করণে ১৮-২০ বছরে দলের কোনো সম্মেলন করেননি। দলকে নেতৃত্বশূন্য করেছেন। তার ব্যক্তিচর্চার কারণে সংগঠন খুবই পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে সম্মেলন করতে দেননি। তার আজ্ঞাবহ লোক দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে কেন্দ্র থেকে কমিটি নিয়েছেন।
মনোনয়নের ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘নেত্রী মনোনয়ন দিলে আমি প্রার্থী। নাহলে না। আমাকে নেত্রী জেলার দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি সাংগঠনিক কাজ করছি। সংগঠন গোছাচ্ছি। উনি যদি নির্বাচন করতে বলেন, করবো।’
সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা ইকবাল মাহমুদ বাবলু বলেন, আমি এলাকায় কাজ করছি, মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। ছাত্রাবস্থা থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আপা (শেখ হাসিনা) যদি নমিনেশন দেন তাহলে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে কাজ করবো। নমিনেশন না পেলেও যিনি নৌকা নিয়ে আসবেন তার পক্ষে কাজ করবো।
দলীয় কোন্দলসহ সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে চাইলে একরামুল করিম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমি যেহেতু দলের পদে নেই, আমি এটা নিয়ে কমেন্ট করতে চাই না। সেখানকার (নোয়াখালী-৪ সদর ও সুবর্ণচর) মানুষও আমাকে ভালোবাসে। কবিরহাটের মানুষও আমাক ভালোবাসে। আমার কাজ হলো মানুষের সেবা করা, মানুষের কাছে থাকা। আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, নোয়াখালী-৪ ও ৫ আসনে মনোনয়ন চাইবো, নেত্রী যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই করবো। নেত্রী যদি মনে করেন যে, ভোট করারই প্রয়োজনই নেই। তাহলে ভোট করবো না।
আন্দোলনের মুডে বিএনপি
আসনটিতে ক্ষমতাসীনদের নানান বিভাজনের মধ্যেও মাঠে নেই বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন বলতে যা বোঝায়- ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার আন্দোলনে তারা ব্যস্ত। এখন নির্বাচন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টি এখন আমাদের মাথায় নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে ব্যস্ত। এই দাবি কীভাবে আদায় করা যায়, সেটি ভাবছি। যে পদ্ধতিতে এখন নির্বাচন হয়, এটাতে আমরা যাবো না। এটি নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই।’
দলটির চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবে রহমান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এ সরকারের পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাবো না। আমাদের দাবি আদায় হলে এবং নির্বাচনে গেলে নোয়াখালী-৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন আমাদের নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান।
ভোটে আধিপত্য বিএনপির
নোয়াখালী-৪ আসনের (সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা) বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা বলছেন, এখানে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। কিন্তু ভোট হয় জোয়ারে। যখন যে দলের প্রতি জোয়ার ওঠে বা হুজুগ থাকে তারাই জেতে। প্রকৃতপক্ষে এখানে ভোটে এগিয়ে বিএনপি। এমনও এলাকা আছে যেখানে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ ঢুকতে পারেনি।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে কথা হয় চটপটি বিক্রেতা জানে আলমের সঙ্গে (ছদ্মনাম)। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেন, ‘এখানকার এমপি মো. শাহজাহান।’ পরে স্মরণ করিয়ে দিলে বলেন, ভাইরে আমরা তাকে চিনি। ভোটও দেই। এখন হয়তো আওয়ামী লীগ আছে।
এই চটপটি বিক্রেতা বলেন, আমার বাড়ি লক্ষ্মীনারায়ণপুর। এখানে ভোট হয় জোয়ারে। যখন যে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি, তারই জয় হয়। তবে ভোট বেশি বিএনপির।
কবিরহাট রোডে আড্ডায় কথা হয় সোনাপুর কাঠপট্টির হোটেল ব্যবসায়ী কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ চরের দিকে (সুবর্ণচর) জনপ্রিয়, কিন্তু শহরে খানা নেই। তারা অনেক অবকাঠামোগত কাজ করেছে। উন্নয়ন হয়েছে ঠিক। কিন্তু এখানে নির্বাচনে জিতবে বিএনপি, এটা সবাই জানে।
জাতীয় সংসদের ২৭১ নম্বর এ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৯। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৭৯ হাজার ২২৪ ও নারী ২ লাখ ৬৫ হাজার ১০৫। আসনটি চারবার ছিল বিএনপির হাতে। ২০০৮ থেকে আছে আওয়ামী লীগের দখলে।
এসইউজে/এএসএ/জিকেএস