সিলেট-৪
১৯৮৬ সাল থেকে একজনের হাতে নৌকা, ভোটে ফ্যাক্টর ‘আবাদি’
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৩২ নম্বর আসন সিলেট-৪। সীমান্তবর্তী এ এলাকাটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। পাথরমহাল, বালুমহাল ও জলমহাল রয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে এখানে আওয়ামী লীগের নৌকা একজনের হাতে। এবার নতুন নেতৃত্ব চান স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাদের দাবি, সামনের দিনগুলোর জন্য নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে এখনই সঠিক সময়। তবে এখানে মনোনয়নে বা দলে নেই কোনো বিভাজন-দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ভোটারদের কাছে বর্তমান এমপি বেশ জনপ্রিয়। মানুষের সম্পৃক্ততা ভালো।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৬ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এই আসনে নির্বাচন করেন ইমরান আহমদ। এর মধ্যে তিনি ছয়বার এমপি হয়েছেন। সবশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং পরে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই আসনে তার বাইরে একমাত্র মনোনয়নপ্রত্যাশী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান।
অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে (৮০ দশক) আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতির শেষ ঠিকানা তো জনপ্রতিনিধি। গত চার-পাঁচটা জাতীয় নির্বাচনে আমরা প্রার্থীর সঙ্গে কাজ করেছি। এতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। গত নির্বাচনে আমি মনোনয়ন চেয়েছি, এবারও চাইবো।’
তিনি বলেন, ‘তরুণ নেতৃত্বের তো দরকার আছে। আমাদের এখানকার এমপি তো প্রবীণ মানুষ। গত ছয়বারের এমপি। তরুণ নেতৃত্ব চাইলে আমার বিষয়টি হয়তো নেত্রী বিবেচনা করবেন।’
কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন বলেন, সিলেট-৪ আসন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এখানে পাথরমহাল, বালুমহাল ও জলমহাল রয়েছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। এখানে আওয়ামী লীগে ওনার বিকল্প উনিই। উনি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভালো মানুষ, উচ্চশিক্ষিত মানুষ। উনি শিক্ষাদরদি মানুষ। ওনার আমলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক, অনেকগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ এখানে নানা উন্নয়ন হয়েছে। এজন্য ওনাকে আগামীতে ফের আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসেবে চাই। এটা আমার ও এলাকার জনগণের দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের এক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান এমপি ইমরান আহমেদ শিক্ষকদের জন্য যুৎসই। তিনি শিক্ষকদের প্রাধান্য দেন সব ক্ষেত্রে। আর শুনলে সরাসরি জনগণের কথা শোনেন। নেতাকর্মীদের সুযোগ দেন না। ওনার কাছে দলীয় নেতাকর্মীরা অবহেলিত। এজন্য আমরা দল ও জনবান্ধব নেতা চাই। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরিবর্তন চাই।’
নজরুল ইসলাম নামে এক ট্রাক ড্রাইভার বলেন, ‘এমপি সাহেব এলাকায় আসেন না। রাস্তাঘাট এমন গাড়ি চালানো যায় না। বালু ও পাথর ব্যবসা বন্ধ করে দিছে। আমরা বলছি, কী করে খামু। উনি বলছেন, বাদাম বিক্রি করতে।’
‘এখানে ধানে শীষের ভোট বেশি।’ দাবি করেন এই ট্রাক ড্রাইভার।
ভোটে ফ্যাক্টর ‘আবাদি’
আবাদি বা সিলেটি এখানকার বিভাজনের পরিভাষা। যারা আদি সিলেটি নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বসতি গড়েছেন, তাদের আবাদি বলা হয়। নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আবাদিদের চিহ্নিত করলেও এখানকার ভোটে এখন তারাই ফ্যাক্টর। ব্যবসাসহ নানা কারণে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বসতি গড়ে এখন তারাই শক্তিশালী। ভোটেও তারাই ফ্যাক্টর। চায়ের কাপের আলোচনায় এমনটাই জানিয়েছেন সেখানকার ভোটাররা।
কোম্পানীগঞ্জ সদরে চায়ের দোকানে পড়ন্ত বিকেলে আড্ডায় মিলিত হয় জাগো নিউজ টিম। সেখানে স্থানীয়রা জানান, তাদের এলাকায় হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ। একের বিপদে অন্যে গিয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক বিভাজন এই সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। তবে এখানে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন আছে আবাদি-সিলেটিদের মধ্যে। যদিও সেটা এখন তেমন নেই। কারণ আধিক্য এখন আবাদিদের। নেতৃত্বেও তারা।
মাহমুদ হাসান নামে এক পেশাজীবী বলেন, ‘আমাদের এখানে (সিলেট-৪) ৭০ শতাংশ ভোটার আবাদি। যে কারণে আবাদিরা নির্বাচনেও এগিয়ে। ইমরান আহমেদ আবাদিদের ভোটেই এমপি হন। তাদের কাছে উনি বেশ জনপ্রিয়।’
মৎস্য ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, আমাদের এখানে বিএনপিই বেশি। বিএনপির দিলদার হোসেন সেলিম বেশ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন এখানকার। তবে বিগত কয়েকবার টানা আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। অবশ্য, আওয়ামী লীগের ইমরান আহমেদ সেরকম দলবাজ না। দলের চেয়ে ওনার কাছে মানুষের গুরুত্ব বেশি।
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের ২৩২ নম্বর আসন সিলেট-৪। মোট ভোটার ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪০১। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০০, নারী ভোটার ১ লাখ ৮৫ হাজার ৮০১।
ভোটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ এর উপ-নির্বাচন, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে এখানে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের এমপি ইমরান আহমদ। এছাড়া ১৯৯৬ ও ২০০১ এ বিএনপি জয় পায়। দলের জোয়ারের চেয়ে এখানে ব্যক্তি জনপ্রিয়তা প্রাধান্য পায় বেশি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দিলদার হোসেন সেলিম পান ৯৩ হাজার ৪৪৮ ভোট।
১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইমরান আহমদ নৌকা প্রতীকে ভোট পান ৬৩ হাজার ৩২৩, স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারুক আহমেদ আনারস প্রতীকে পান ২৪ হাজার ২৭৮ ভোট।
৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইমরান আহমদ নৌকা প্রতীকে ভোট পান ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৮, বিএনপির প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিম ধানের শীষ প্রতীকে পান ৯৮ হাজার ৫৪৫।
৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) বিএনপির দিলদার হোসেন সেলিম ৬২ হাজার ৩২৪ ভোট পান, আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ পান ৪৭ হাজার ৬০৮ ভোট।
৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) বিএনপির এম সাইফুর রহমান ২৩ হাজার ৯৪৬ ভোট পান, আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ পান ২২ হাজার ৭২৫ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ ২৩ হাজার ১৮ ভোট পান, বিএনপির নাজিম কামরান চৌধুরী পান ১৪ হাজার ৫০৮ ভোট।
এসইউজে/এএসএ/জিকেএস