মৌলভীবাজার-৩
বিএনপির কান্ডারি নাসের রহমান, অন্তর্কোন্দলে যত ভয়
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-৩ আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির জনপ্রিয়তা সমানে সমানে। দলের বাইরে ব্যক্তি হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন দুই দলের দুই প্রয়াত নেতা সৈয়দ মহসীন আলী ও এম সাইফুর রহমান। তাদের উত্তরাধিকারীরাই এখনো দুই দলের প্রধান ভরসা। বিএনপিতে সাইফুর রহমানপুত্র নাসের রহমান জনপ্রিয়তায় এগিয়ে। তবে কিছু বিতর্ক আছে তাকে নিয়ে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চান জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। আবার সাধারণ মানুষের মুখে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাসের রহমানের স্ত্রীর নামও শোনা যাচ্ছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এম সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের রহমান। গত নির্বাচনে এই আসন থেকে জেলা বিএনপির সভাপতি নাসের রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন নাসের। আগামীতেও তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে দুজনকে ঘিরেই রয়েছে পারস্পরিক অভিযোগ। আর সাধারণ মানুষের মুখে নাসের রহমান ও তার স্ত্রীর নাম।
স্থানীয় বিএনপিতে সাংগঠনিক বিভক্তি থাকলেও ভোটের মাঠে তা টিকবে না বলে মনে করেন নেতারা।
স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সাত্তার বলেন, এখানকার নির্বাচনে কখনো জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত আজিজুর রহমান বা সৈয়দ মহসীন আলী। আবার কখনো বিএনপির এম সাইফুর রহমান। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময় তাদের জয় হয়েছে এমনটাও নয়। ’৯১-এ বিএনপি সরকার গঠন করলেও এখানে আওয়ামী লীগ জিতেছে। ’৯৬-তে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও এখানে বিএনপি জিতেছে। অর্থাৎ, দলের বাইরেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা ছিল। তাদের পরিবারের প্রতিও এখানকার মানুষের একটা সহানুভূতি আছে।
তিনি বলেন, দুই পরিবারের দুজনকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে মনোনয়ন দিলে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। তবে এখানে জেলা বিএনপি সাইফুর রহমানপুত্র নাসের রহমানকে সামনে রাখলেও জেলা আওয়ামী লীগ মহসীন আলীর পরিবারকে সাইড করে ফেলছে। এর প্রতিফলন মনোনয়নেও হলে মাশুল দেবে নির্বাচনে।
প্রবাসী আব্দুল আলিম বলেন, এখানে নাসের রহমানের জনপ্রিয়তা আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি জয় পাবেন। তবে মহসীন আলীর সরলতা, সততা ও নিষ্ঠার কারণে তার পরিবারকেও পছন্দ করে এলাকার লোকজন। তাদের মধ্যে ভোট হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অন্যথায় বিএনপি একচেটিয়া জিতে যাবে। কারণ এই আসনটিতে বিএনপির ভোট বেশি।
রাজনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জিতু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এই আসনে বিএনপির প্রার্থী নাসের রহমান। বিভক্তি যাই থাকুক না কেন, ভোটের সময় সেটা থাকে না।
আগামীতে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচন প্রসঙ্গে নাসের রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রস্তুত আছি। মৌলভীবাজারের রাজনীতিতে আমাকেই সব কিছু ডিরেকশন দিয়ে করতে হয়, করাতে হয়। সারাদেশের মতো আমরাও প্রস্তুত। আগামী নির্বাচন কোনো অবস্থায়ই এই সরকারের অধীনে হবে না। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে হবে না এবং ইভিএম মেশিন দিয়ে কোনো নির্বাচন হবে না।
‘প্রধানমন্ত্রী যা বলে যাচ্ছেন এটা তিনি বলতেই পারেন, সেটা তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার জন্য। এখান থেকে আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে দেশে বহু ঘটনা ঘটবে। তবে এটা নিশ্চিত, আর যাই হোক শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না।’
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ওরা আন্দোলন করছে করতে দাও, আক্রমণ করবা না, তারপর ৪৬ জায়গায় বিএনপির মিছিলে আক্রমণ হয়েছে। বিএনপি তো ঢাকার মধ্যে মিছিল করতে পারছে না। বিএনপি তো মিছিল করছে জেলা হেডকোয়ার্টারগুলোতে। সেই জেলা হেডকোয়ার্টারগুলোতে আমাদের মিছিল করতে দিচ্ছে না। আমরা ২০১৩ সালের মতো ভুল করবো না। ২০১৪ সালে স্ট্রাটেজিক একটা ভুল করে ফেলেছিলাম নির্বাচনের পরে আন্দোলনটা জিইয়ে না রেখে।
তিনি বলেন, আমাদের তিনটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কারণে তারা সারাদেশে মিছিল করছে। ঢাকায় করছে আমাদের মৌলভীবাজারেও করছে। কয়েক জায়গা তারা টলারেট করেনি, বেশিরভাগ জায়গা ইনটলারেট। আমরা মোটামুটি আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রস্তুত। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মৌলভীবাজারে তিনটি আসন তো নিশ্চিত, চারটাও ধানের শীষ পেতে পারে।
স্ত্রীর মনোনয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী নয়, আমি এই আসনের জন্য ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবো। আমার স্ত্রী কিন্তু ওভাবে অ্যাকটিভ নয়। ঢাকায় যোগাযোগ করে, কিন্তু এলাকায় সে অ্যাকটিভ নয়।
কিছু বিতর্কিত বিষয়ে এই নেতা আরও বলেন, এখানে একটা দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু সেটা আমার বিষয় নয়, আমাদের দলের জেলার সেক্রেটারির। তিনি একটু বিতর্কিত। তাকে নিয়ে একটু সমস্যায় আছি। এটা আমি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিটিং করে ব্যাপারটা বলেছি। উনি নিশ্চিত করেছেন সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এগুলো পাবলিকলি আর বলতে চাচ্ছি না।
নাসের রহমানের স্ত্রী রোজিনা নাসের বলেন, নাসের রহমান এত বছর ইলেকশন করেছেন। উনি তো সব সময় প্রস্তুত থাকেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই আসন ধানের শীষের। সুষ্ঠু হলে ইনশাল্লাহ এই সিট আমাদের।
যাকে ঘিরে নাসের রহমানের অভিযোগ সেই মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এ আসন থেকে নাসের রহমান সাহেব হয়তো নমিনেশন পাবেন। আমরা বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন করলেও আমাদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য আছে।
নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে মিজান বলেন, আমি জানি না নাসের রহমান সাহেব কী কারণে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আমি সংগঠনের গঠনতন্ত্র মোতাবেক চলতে চাই, এটা ওনার বিরোধিতা হয়? নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই আসন বিএনপির নিশ্চিত।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৩৭ নম্বর আসন মৌলভীবাজার-৩। এখানে ৩ লাখ ৯১ হাজার ২৬৮ জন ভোটার। ১ লাখ ৯৭ হাজার ১২২ পুরুষ ও ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৬ নারী ভোটার।
বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেছার আহমদ পান ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৯ ভোট। তার নিকটতম বিএনপির এম নাসের রহমান পান ১ লাখ ৪ হাজার ৫৯৫ ভোট।
১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের সৈয়দ মহসীন আলী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দ মহসীন আলী নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯২১ ভোট পান। বিএনপির এম সাইফুর রহমান ধানের শীষে পান ১ লাখ ১২ হাজার ৮৯৫ ভোট।
৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) বিএনপির এম সাইফুর রহমান পান ১ লাখ ৮ হাজার ৫১৩ ভোট ও আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান পান ৯৫ হাজার ৩১৯ ভোট।
৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) বিএনপির এম সাইফুর রহমান ৮৪ হাজার ২৯২ ভোট পান। আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান পান ৬৩ হাজার ১৭৭ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচন (১৯৯১) আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান পান ৫৫ হাজার ৯৭৭ ভোট। জাতীয় পার্টির গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী পান ৩৮ হাজার ৫২৮ ভোট।
কেএইচ/এএসএ/এএসএম