মৌলভীবাজার-২
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সুলতান মনসুরের ডিগবাজিতে ভোটে পিছিয়ে আওয়ামী লীগ
টানা দুই দশক মৌলভীবাজার-২ আসনে ক্ষমতার বাইরে আওয়ামী লীগ। দলের প্রধান নেতার ডিগবাজি, জোট থেকে অন্য দলের প্রার্থীকে মনোনয়ন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে ক্রমে এই আসনে ভোট কমছে ক্ষমতাসীন দলটির। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনেও ভালো ফলাফল আসবে না বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি নতুন মুখ। আর সাধারণ জনগণ বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ এবারও তাদের আসন পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।
সরেজমিনে নির্বাচনী এলাকা কুলাউড়া ঘুরে এ চিত্র পেয়েছে জাগো নিউজ টিম।
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা সুলতান মনসুরের আসন এটি। এখানে হওয়ার কথা নৌকার ঘাঁটি। সেখানে উল্টো ধানের শীষ নিয়ে এমপি হতে হয়েছে সুলতান মনসুরকে। যে কারণে এখানে আওয়ামী লীগ ভোটে আরও পিছিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা মনে করেন, ডিগবাজির কারণে সুলতান মনসুর পচে গেছেন। তিনি যে প্রতীকেই নির্বাচন করুন না কেন আর পাস করবেন না।
আফজাল হোসেন নামে এক অটোরিকশাচালক বলেন, ‘আমাদের এখানে বিএনপির ভোটার বেশি। সুষ্ঠু ভোট হলে যাবে ধানের ছড়া।’
তিনি বলেন, ‘এখন কি দেশে নেতা আছে? নেতা আছিল জব্বার সাব (মরহুম আব্দুল জব্বার এমপি)। এখন তার ছেলে আছেন (আবু জাফর রাজু)। তিনি বাপের মতো ভালো লোক।’
আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ফাতেমা আক্তার নামে এক চা দোকানি বলেন, কুলাউড়ায় কোনো মারামারি নাই। অশান্তি নাই। যে যার মতো কাজ করে।
একইভাবে বিএনপি ঘরানার হিসেবে পরিচিত এম এম শাহীন অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র ভোট করে জয় পেয়ে পথ হারিয়েছেন। নবম সংসদেও স্বতন্ত্র থেকে ভোট করেন এবং পরাজিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে তিনি এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থনে বিকল্প ধারার প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট করে হেরেছেন। যে কারণে এখন এখানে বিএনপির একক প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবেদ রেজা।
আড্ডায় অটোচালক আফজাল হোসেন বলেন, ‘যে প্রতীকই আনুক এই দুজন (সুলতান মনসুর ও এম এম শাহীন) পাস করবেন না। বিএনপির আবেদ রেজা ও আওয়ামী লীগের আবু জাফর রাজুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’
কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেণু বলেন, এটি আওয়ামী লীগের আসন। নৌকা দিলে পাস করবে। গতবার বিতর্কিত একজনকে নৌকা দিয়েছে। আমরা তারপরও এক হয়েছিলাম। তারপর মধ্য রাতে ফলাফলের আগেই অন্য কিছু হয়ে গেলো। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য অন্যদিকে চলে গেলো। নতুবা তো এরকম হতো না। নৌকা পাস করতো। যে কাউকে দিলেই হয়তো তারতম্য হতে পারে, কিন্তু পাস করবে।
কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম বলেন, ’৯৬-এর পরে এখানে আর নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়নি। তৃণমূল থেকে প্রার্থী চান নেতাকর্মী ও ভোটাররা। কারণ গতবার দেওয়া হয় বিকল্প ধারা থেকে। তিনি তো আওয়ামী লীগের নন। তারপরও আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে তার পক্ষে কাজ করেছি। এর আগে (২০১৪) আমরা অনেকে নৌকা চেয়েছি। জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হলো। পাস করলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের আব্দুল মতিন সাহেব। এখানে নৌকার প্রার্থী তৃণমূল থেকে দিলে পাস করার সম্ভাবনা বেশি। নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেক ক্ষোভ-দুঃখ আছে। সুলতান মনসুর সাহেবের ডিগবাজির পর যে সমস্যা হয়েছে- দলের মূল মানুষ প্রার্থী হিসেবে আসেননি।
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলাম তায়েফ বলেন, আমাদের এখানে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ চলছে। এখন তো ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী এমপি। সামনে নৌকার এমপি হবে ইনশাআল্লাহ।
সুলতান মনসুর সাহেবকে নৌকা দিলে পাস করবেন কি না, জবাবে ছাত্রলীগের সভাপতি বলেন, এটা তো বলতে পারি না। তবে গত নির্বাচনে উনি দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন করেছেন। এটার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার অনেক গ্যাপ। এখন পর্যন্ত তিনি স্বতন্ত্র একটা অবস্থানে আছেন। দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ জাতীয় সংসদের ২৩৬ নম্বর আসন। এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৪১ হাজার ১৬১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৪২২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৩৯।
ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর পান ৭৯ হাজার ৭৪২ ভোট এবং নৌকা প্রতীকে বিকল্প ধারার এম এম শাহীন পান ৭৭ হাজার ১৭০ ভোট।
১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মতিন আনারস প্রতীকে পান ৩০ হাজার ৮৭১ ভোট। জাতীয় পার্টির মহিবুল কাদির চৌধুরী লাঙল নিয়ে পান ২৫ হাজার ২৪১ ভোট।
৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৪১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীন ফুটবল প্রতীকে পান ৬৪ হাজার ৯৪২ ভোট।
৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) স্বতন্ত্র থেকে এম এম শাহীন ফুটবল প্রতীকে ৭৮ হাজার ৬৬৭ ভোট এবং আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে পান ৭১ হাজার ৮০৩ ভোট।
৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে ৫২ হাজার ৫৮২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান লাঙল প্রতীকে পান ৩৯ হাজার ৯৯২ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টির নওয়াব আলী আব্বাস খান লাঙল প্রতীকে ৬১ হাজার ১০৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদ নৌকা প্রতীকে পান ৪৫ হাজার ৫২৬ ভোট।
এসইউজে/এএসএ/এমএস