মৌলভীবাজার-১
বিএনপির ‘নীরব সমর্থক’ ভয় আওয়ামী লীগের
হবিগঞ্জ মানেই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। প্রায় সব আসনেই দলটির আধিপত্য। চা শ্রমিকরা সেখানকার ভোটের অন্যতম ফ্যাক্টর। পাশের জেলা মৌলভীবাজার। এ জেলার আসনগুলোতেও আছে চা শ্রমিকের আধিক্য। তবে আওয়ামী লীগের অবস্থান একচেটিয়া নয়। বিএনপির আছে বড় ভোটব্যাংক। জাতীয় পার্টিরও ভোট ছিল কিছু আসনে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এখন অনেকটাই নীরব। তবে সুযোগ পেলে এই ‘নীরব’ সমর্থকরাই ঘুরিয়ে দিতে পারে ভোটের মোড়।
জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৩৫ নম্বর আসন মৌলভীবাজার-১ ঘুরে নেতাকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র মিলেছে। ভোটারদের সঙ্গে কথা হয়েছে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে। গেলো নির্বাচনের পর নেতাদের এলাকায় সম্পৃক্ততা, সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি নেতাদের সহানুভূতি প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে আলোচনায়।
বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণবাগ বাজারে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে। তারা বলছেন, এই এলাকায় মানুষ অধিকাংশই দিনমজুর, কিছু ব্যবসায়ী ও প্রবাসীও আছেন। মানুষের সুখে-দুঃখে রাজনৈতিক নেতাদের সেভাবে পাওয়া যায় না। বরং বিপদে পড়ে তাদের কাছে গেলে সুযোগ নেয়। উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করে।
বানভাসি মানুষকে জনপ্রতিনিধিরা পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেছেন কি না- জানতে চাইলে সুমন আহমেদ নামে এক চা দোকানি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে চাহিদামতো ত্রাণ দেওয়া হয়নি। বরং ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বেসরকারিভাবে বেশি ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণত এখানে নৌকা জেতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি জেতার সম্ভাবনা আছে। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন দিনমজুর আব্দুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘মানুষ কষ্টের মধ্যে আছে। আগে কাজ করলে ৪শ টাকা দিলেও চলতে পারতাম। এখন ৫শ টাকা পেয়েও চলতে পারি না।’
তবে বর্তমান এমপি বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন কিংবা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এবং তারা ভালো মানুষ বলে মন্তব্য করেন দুজনই।
সুমন ও আব্দুর রহমান বলেন, এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই সংগঠন আছে। আওয়ামী লীগ বেশি দেখা যায়, বিএনপি কম। তবে বিএনপির জনসমর্থন আছে ভেতরে ভেতরে।
দোকানি গৌর দাস বলেন, চা বাগানের বাইরে লোকালয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থান সমান সমান। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকদের একচেটিয়া ভোট পায় আওয়ামী লীগ। যার কারণে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকে।
‘বড়লেখায় ১৮টি ও জুড়িতে ১৬টি চা বাগানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার ভোট আছে।’ জানান এক বাগানের হাসাপাতালে চাকরিরত বকুল বাউরি।
ইলেকট্রিক মিস্ত্রি জুনায়েদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু কিছু নেতার কারণে সে উন্নয়ন ম্লান হয়ে যায়। পাতি নেতারা মানুষের উপর নির্যাতন করে।’
‘স্থানীয় এমপি আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতের লোকদেরও কথা শোনেন এবং উচ্ছৃখল নেতাদের পাত্তা দেন না।’ দাবি গৌর দাসের।
জুড়ী চৌমহনায় এক আড্ডায়ও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানকার লোকজন বলছেন, এখানে আওয়ামী লীগের ভোট বেশি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি খারাপ। যার কারণে নিম্ন বিত্তের মানুষ কষ্টে আছে। তাদের ভোটও একটা ফ্যাক্ট।
এসব বিষয়ে পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জুবের হাসান জেবলু জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে দলীয় অবস্থা মোটামুটি ভালো। নৌকার একটা ভোট আছে। কয়েকটা চা বাগানের শ্রমিক এবং বাইরের কিছু লোক আমাদের ফিক্সড সমর্থক ও ভোটার। বাকি সব এন্টি আওয়ামী লীগ। বিএনপির কর্মকাণ্ড আছে এখানে। তাদের নীরব সমর্থকও আছে বেশ।
জুড়ী উপজেলা যুবলীগের শিক্ষা ও পাঠাগার সম্পাদক ফয়সল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, এখানে আমাদের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা ভালো। নৌকার অবস্থান ভালো। তবে বিএনপি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করে। তাদের কিছু নীরব সমর্থক আছে।
জুড়ী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক হুমায়ুন রশিদ রাজী বলেন, আমাদের উপজেলায় আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। বড়লেখায় বিএনপির ভোট বেশি। এতদিন বিএনপির তেমন দেখা না মিললেও সম্প্রতি তারা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, মৌলভীবাজার-১ আসনে (বড়লেখা এবং জুড়ী উপজেলা) মোট ভোটার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৯। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৩৬ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩ জন।
ভোটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের মো. শাহাব উদ্দিন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নাসির উদ্দিন মিঠু পান ৬৫ হাজার ৮৫৩ ভোট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের শাহাব উদ্দিন ১ লাখ ৪ হাজার ২০ ভোট পান। জাতীয় পার্টির আহমেদ রিয়াজউদ্দিন পান ৯ হাজার ৬৪৯ ভোট।
৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের শাহাব উদ্দিন ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭০ এবং বিএনপির এবাদুর রহমান চৌধুরী ৬৯ হাজার ৬১৯ ভোট পান।
৮ম সংসদ নির্বাচন (২০০১) বিএনপির এবাদুর রহমান চৌধুরী ৪৯ হাজার ২৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের শাহাব উদ্দিন পান ৪৭ হাজার ৫৩৯ ভোট।
৭ম সংসদ নির্বাচন (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের শাহাব উদ্দিন ৩৩ হাজার ১৭৯ ও বিএনপির এবাদুর রহমান চৌধুরী পান ২০ হাজার ৪৭ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচন (১৯৯১) জাতীয় পার্টির হয়ে এবাদুর রহমান চৌধুরী লাঙল প্রতীকে ২৭ হাজার ৯০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের ইমান উদ্দিন আহমেদ পান ২৭ হাজার ৫৫৮ ভোট।
এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। সুষ্ঠু ভোট হলে বেশ লড়াই হয়। তবে ফ্যাক্টর চা বাগানে শ্রমিকরা।
এসইউজে/এএসএ/জেআইএম