রাজপথে শক্তি বাড়ছে বিএনপির?
বিএনপির কোনো কর্মসূচি মানেই গোটা কয়েক অপরিচিত মুখ আর দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। হুটহাট পথে নেমে ঝটিকা মিছিল করেই শেষ অবস্থান জানান দেওয়া। গত কয়েক বছর রাজধানীতে এই চিত্র দেখায় অভ্যস্ত জনগণ। আর সারাদেশের কথা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি বদলেছে সেই চিত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দলের নেতাকর্মীদের হত্যা প্রভৃতি কর্মসূচিতে সারাদেশেই নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কণ্ঠে ছিল তাদের ঝাঁঝালো স্লোগান। হাতে বাঁশ-লাঠিও দেখা গেছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি বিএনপি রাজপথে আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে?
বিএনপি জোটের দীর্ঘদিনের শরিক জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া, না ছাড়ার বিতর্কের মধ্যেই আলোচনায় এসেছে রাজপথে বিএনপির পরিবর্তিত অবস্থান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও বিএনপির লাঠি নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এছাড়াও ডিএমপি থেকেও লাঠি নিয়ে কাউকে সমাবেশে আসতে নিষেধ করা হচ্ছে। যদিও কম যাচ্ছে না কোনো পক্ষই!
বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিনের কোণঠাসা বিএনপি হঠাৎ কী এমন জাদুমন্ত্রে রাজপথে সরব হলো? বিএনপির এই আন্দোলনের শক্তি কি বাড়ছে, তাহলে শক্তির উৎস কী?
দলীয় সূত্র বলছে, বিগত ১৪ বছরে সরকারে দমন-নীতির কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই দলীয় গ্রুপিংকে বর্তমানে ছোট করে দেখে সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর বিরোধীদলের লোকজনের অন্তর থেকে খুন-গুমের ভয় কেটে গেছে বলে মনে করছেন কিছু নেতাকর্মী। অনেকে এখন বিশ্বাস করেন, র্যাব-পুলিশ গুলি করে মেরে ফেললে দেশে বিচার না হলেও প্রশাসন চাপে পড়বে। যে কারণে ভোলা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা রাজপথে স্বতঃস্ফূর্ত। পাশাপাশি সম্প্রতি কূটনৈতিক তৎপরতাও নেতাকর্মীদের মনে সাহস জোগাচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
ভোলা থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সরকার বিদেশিদের কাছে দেন দরবার করছে। সরকারের এই ষড়যন্ত্র জনগণ বুঝতে পেরেছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। তাই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে।’
মুন্সিগঞ্জ-২ আসনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘এই সরকার চেষ্টা করছে আরেকটা অবৈধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার জন্য। কিন্তু জনগণ তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে আন্দোলনে শামিল হচ্ছে। জনগণ এই সরকারের পতন চায়, সুশাসন চায় একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’
বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের শক্তির উৎস জনগণ। বিগত দুটি নির্বাচনের আগে-পরে আমরা আন্দোলনে সফল ঠিকই ছিলাম, হয়তো সরকারের পতন ঘটাতে পারিনি। কিন্তু এবার আমরা দেশের জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি আমাদের সরকারের সময় দেশের মানুষ চাল, ডাল, তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেমন দামে কিনেছে আর বর্তমানে কত বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস। তাই জনসাধারণ আমাদের আন্দোলনে সাড়া দিচ্ছে। আমরাও উজ্জীবিত, জনগণও উজ্জীবিত।’
বিগত কয়েক মাস ধরে বিএনপি মাঠে আন্দোলন করার পাশাপাশি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গেও ঘন ঘন বৈঠক করছে। কিছুদিন আগে ব্রিটিশ হাইকমিশনার, কানাডিয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তা, জাপানের রাষ্ট্রদূত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বলয়ের দেশগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির প্রতিনিধিদল।
বিদেশি দেশগুলো থেকে এবার আন্দোলনে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এবার আন্দোলনে আমরা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কারণ আমাদের আন্দোলন তো দেশে ভোটাধিকারের জন্য, মানবাধিকারের জন্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য। সুতরাং, বিদেশি দেশগুলোর সমর্থন আমরা পাচ্ছি। বরাবরের মতোই আমাদের আন্দোলনে তাদের সমর্থন রয়েছে।’
‘আমাদের আন্দোলনের মূল শক্তি জনগণ। জনগণ সাড়া দিয়েছে বলেই আমাদের আন্দোলন দিনের পর দিন জোরালো হচ্ছে। জিয়াউর রহমানের দল জনগণ ছাড়া অন্য কাউকে কখনো শক্তির উৎস মনে করে না।’
চীন, রাশিয়া, ভারত- এসব দেশের ঢাকার রাষ্ট্রদূত বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার কোনো পরিকল্পনা বিএনপির রয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি প্রয়োজনে যে কোনো দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গেই বৈঠক করতে পারে, বিএনপি সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়।’
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ১৩-১৪ বছরের চেয়ে সম্প্রতি বিএনপির সমাবেশে নেতাকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ কতটুকু বেড়েছে এটা এখনো পরিমাপ করার সময় আসেনি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেখেছি নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ মিছিল-সমাবেশে যোগ দিতো। এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। এই যে সমাবেশে নেতাকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে এটা বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপির আসল সমস্যা কিন্তু ভেতরে রয়ে গেছে। শরীরের চামড়ার নিচে ফোড়া রেখে উপরে মলম দেওয়ার মতো।’
সমাবেশে লাঠি হাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা/সংগৃহীত
‘ভিতরে সাংগঠনিক জটিলতা, দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা- সেটা কিন্তু রয়ে গেছে। এখনো বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কোন্দল চলছে। গ্রুপিং চলছে। সবাই একত্রিত হয় না। এই সমস্যার সমাধান না করলে ঘুরে দাঁড়ানো যেটা বলে, ঘুরে একদম আওয়ামী লীগের মুখোমুখি- সেই শক্তি বিএনপি এখনো অর্জন করতে পারেনি। এটা সময় লাগবে। তার আগে বিএনপির ঘরের সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা একটা রাজনৈতিক লড়াই করতে পারবে।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক বলেন, ‘বিএনপির এবারের আন্দোলনের ইস্যুটি খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ, যা দেশের নিম্ন-স্বল্প আয়ের মানুষের দাবির সঙ্গে একবারে মিলে গেছে। যে স্বল্প আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এবং বিএনপির নিহত চার-পাঁচজনও নিম্ন আয়ের মানুষ। যখন রাষ্ট্রের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়, তখনই সেই আন্দোলনের গতিবেগ অনেক গুণ বেড়ে যায়। যেমনটা আমাদের ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০ এর স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের সময়ও দেখা গেছে। তাই বিএনপির চলমান এই আন্দোলন জোরালো হচ্ছে, দিন দিন এই আন্দোলন জনসম্পৃ্ক্ত হচ্ছে, সামনের দিনে আরও বেশি মানুষ এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে বলে মনে হচ্ছে।’
বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে নেতাকর্মীরা/সংগৃহীত
তিনি বলেন, সম্প্রতি বিএনপি দেশের আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে। বিএনপির বর্তমান আন্তর্জাতিক অ্যাফেয়ার্স টিম খুব অ্যাক্টিভভাবে কাজ করছে। গত কয়েক মাসে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যে পরিমাণ যোগাযোগ হয়েছে, তা বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীরাও মনে করছেন বিএনপির আন্দোলনে বিদেশিদের সমর্থন রয়েছে, সরকার পরিবর্তন ঘটতে পারে- এই কারণেও বিএনপির নেতাকর্মীদের আন্দোলনে নামতে উৎসাহ জোগাচ্ছে, আশাবাদী করছে।’
তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি ইত্যাদি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বলয়ের সঙ্গে বিএনপির সম্প্রতি একটি বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে। এতে বিএনপির চলমান আন্দোলনে মার্কিন বলয়ের সমর্থন পাচ্ছে এবং আন্দোলনও বুস্টআপ হচ্ছে বলে মনে করছে জনগণ।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্য ‘যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন অনেক বেশি সংগঠিত। বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ সাংগঠনিকভাবে চোখে পড়ার মতো। একটা বড় দলে অনেক সমস্যা থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনে সব সমস্যা মিটিয়ে সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করছি। এমনকি যেসব সংসদীয় আসনে আমাদের তিন-চারজন করে প্রার্থী ছিল নির্বাচনের জন্য, সে জায়গাগুলোতে সবাই একসঙ্গেই আন্দোলন করছেন, এটা একটা ইতিবাচক দিক। বিএনপির সবাই এখন মরিয়া। কারণ, আমাদের কোনো বিকল্প নেই তো। এবার হয় জিততে হবে, না হয় মরতে হবে।
কেএইচ/এএসএ/জেআইএম