‘বিএনপির সুসময়ে কখনো ছিলাম না, দুঃসময়ে ছিলাম’
ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদেও। তবে গত এপ্রিলে তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ব্যক্তিগত রাজনীতি, দলীয় রাজনীতিসহ চলমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন এহছানুল হক মিলন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খালিদ হোসেন।
জাগো নিউজ: দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
এহছানুল হক মিলন: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরও বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতি এখন শূন্যতায়। এদেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ১৬৭টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় না যেতে পেরে এই গণতন্ত্রের জন্যই স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই গণতন্ত্র আজ বাংলাদেশে নেই। বিচারহীনতা, দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়, এরপর শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বকালের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। সবকিছু মিলিয়ে দেশ খুব কঠিন সময় অতিবাহিত করছে।
জাগো নিউজ: দলীয়ভাবে এখন আপনি কোন পদে রয়েছেন?
এহছানুল হক মিলন: দলীয়ভাবে আমি এখন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হয়েছিলাম। ২৯ বছর পর গত এপ্রিলে আমাকে সেই পদ থেকে নির্বাহী কমিটির সদস্য বানানো হয়।
জাগো নিউজ: কী কারণে আপনাকে এই পদ থেকে সরানো হলো?
এহছানুল হক মিলন: মূলত আমার পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই, দেশের বাইরে যেতে পারছি না। বাংলাদেশ জর্জরিত, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা কাজ করতে পারবেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাগো নিউজ: শোনা যাচ্ছে দল আপনাকে নতুন করে দায়িত্ব দিচ্ছে, নিয়মিত আপনি কার্যালয়ে বসবেন, এ তথ্যের সত্যতা কতটুকু?
এহছানুল হক মিলন: পার্টি আমাকে এখনো কিছু জানায়নি। আপনি যেমন শুনেছেন, আমিও তেমন শুনেছি। পার্টি এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি।
জাগো নিউজ: দলের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আপনার নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা আছে?
এহছানুল হক মিলন: হ্যাঁ, অবশ্যই পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হবে, যে কোনো মূল্যে সেই নির্বাচনে আমাদের জয়যুক্ত হতেই হবে এবং এ জাতিকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিতে হবে। মানবাধিকার, সাম্য, বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি থেকে মুক্তি আর এই অপশাসন থেকে দেশকে বের করে আনতে হবে, এটা বিএনপির ঈমানি দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন করার জন্য জনগণের জন্য বিএনপি এখন আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইনশাআল্লাহ দেখতে পাবেন।
জাগো নিউজ: দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন, আপনার যেমন সুনাম রয়েছে পাশাপাশি সমালোচনাও রয়েছে...।
এহছানুল হক মিলন: রাজনীতিবিদদের পথ সহজ না হওয়া অনেক ভালো। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় আমি নাকি চাঁদাবাজি করে হেলিকপ্টার উড়িয়ে নকল প্রতিরোধ করেছি। পত্রিকায় এসেছে, আমি এটা চ্যালেঞ্জ করেছি, আমি কারও কাছে চাঁদাবাজি করিনি। যদিও আমি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নই। ১/১১ এর সময় আমি একজন দায়িত্বশীল নেতা ছিলাম, অথচ আমার বিরুদ্ধে একটিও দুর্নীতির মামলা করতে পারেনি। অপরদিকে আমাকে ৭০ বছরের বেশি বয়সী হিন্দু নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা, ছিনতাই-ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়েছে। আমাকে চার বছর কারাগারে রাখা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো ঘটছে, কেউ হয়তো ভাবতেই পারে না। আপনি খোঁজ নেন, দেখবেন মিলনের নামে কত মামলা। যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে উইকিপিডিয়াতে মিলনের নাম সার্চ করেন তাহলে নিশ্চয়ই বলবেন এই লোকটি বাজে লোক, তার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা। বছরের পর বছর জেল খাটে, এমনকি জঘন্য মামলা। সে কারণে আমি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নই।
জাগো নিউজ: অনেকে বলেন আপনি সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ, এটা আসলে কতটা ঠিক?
এহছানুল হক মিলন: ১৯৮০ সালে ছাত্রদল গঠন হওয়ার পরে জিয়াউর রহমান আমাকে এই দলে এনেছিলেন। সেসময় থেকে দল সংগঠিত করেছি। আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছিলাম, তখনও দলের দুর্দিনে জাতিসংঘে আন্দোলন করেছি প্রচণ্ড বরফের ভেতরে। ৯১-তে ছিলাম না, ৯৬-তে এমপি হয়েছি। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মহিউদ্দিন আলমগীরকে হারিয়েছি। সে কারণে খালেদা জিয়া আমাকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব উপহার দিয়েছিলেন, আমি সেটা কঠিনভাবে পালন করেছি। আমি কখনো বিএনপির সুসময়ে ছিলাম না, দুঃসময়ে ছিলাম। এই দুঃসময়েও আছি এবং আমি একমাত্র ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বিসর্জন দিয়ে পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েছি। মন্ত্রী হয়ে কাজ করেছি এবং এখনো আমি দেশে আছি। মামলার জন্য বাইরে যেতে পারছি না। সব সময় আমি দলের সঙ্গে আছি, জানি না কখন সুসময়ে ছিলাম।
জাগো নিউজ: অনেকেই বলছে বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে, আপনি এ বিষয়ে কী বলবেন?
এহছানুল হক মিলন: যারা বলছে তারা না জেনেই বলছে। নির্বাচনের এখনো ১৭ মাস বাকি রয়েছে। ১৭ মাস আগে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গণতান্ত্রিক শক্তিমান দেশগুলো সবাই নির্বাচন কমিশনে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে। বিএনপি যদি আন্তর্জাতিক মহলে এতটা দুর্বল হতো তাহলে ডিপ্লোম্যাটরা বাংলাদেশ নিয়ে এতটা সচেতন হতেন না।
জাগো নিউজ: বলা হয় আপনি মন্ত্রী থাকাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন, আগামীতে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আপনাকে কোথায় দেখতে পাবেন?
এহছানুল হক মিলন: শুভাকাঙ্ক্ষীরা তো অনেক জায়গায় দেখতে চান। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি দেশের সেবা করতে হয়, তাহলে একটি জায়গা থেকে সেবা করার বড় সুযোগ, সেটি হচ্ছে শিক্ষা। আমি মনে করি এটি হচ্ছে একমাত্র মন্ত্রণালয়, যা বিশ্বের মানচিত্রে দেশকে উন্নত স্থানে নিয়ে যাবে। সেজন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেক কিছু আশা করেন। আমি মনে করি এই দায়িত্বটি হচ্ছে সবচেয়ে ভালো দায়িত্ব।
জাগো নিউজ: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী বলবেন?
এহছানুল হক মিলন: যেভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে, আমার মনে হয় আমাদের যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনমিতিক লভ্যাংশ) পে করার কথা, এই শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে সেই জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না। ২০৪১ সালে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পে করার সময়। আর এই ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের যুগে ফোর-জি জেনারেশনে (চতুর্থ প্রজন্ম) আমাদের দেশ ন্যানো টেকনোলজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারছে না। এমনকি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো, সেটাও র্যাংকিংয়ে এক হাজারের মধ্যে থাকতে পারছে না। শিক্ষকদের রাজনীতি এবং বর্তমান শাসনামল শিক্ষাব্যবস্থায় ধস নামিয়েছে।
কেএইচ/ইএ/এএসএ/এমএস