এখনই ইভিএমে ভোট চায় না অধিকাংশ দল
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএমে) ব্যবহারে বিরোধিতা করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নয়টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাদের মতে, ইভিএম সমস্যা নয়। গোপন কক্ষে ভোট ডাকাতি প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষ ভোট বিমুখ হয়ে পড়বে। এজন্য এখনই জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করতে মত দিয়েছেন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
রোববার (১৯ জুন) বিকেল ৩টায় ইভিএম যাচাইয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত বৈঠকে অংশ নিয়ে এমন অবস্থানের কথা জানিয়েছে ১০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.), রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ মিশন টুলস ফ্যাক্টরির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইভিএম যাচাই করার জন্য ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করার জন্য ডেকেছে নির্বাচন কমিশন। রোববার ১৩টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি। এর মধ্যে ১০টি দল রোববার এসেছে।
দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি-জেপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস।
এগুলোর মধ্যে আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, ড. কামাল হোসের গণফোরাম ও কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বৈঠকে আসেনি।
বৈঠকের পর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দেশের মানুষ এখনো ইভিএম এ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ এখনো মনে করেন ইভিএম মানেই কারসাজি। কেউ কেউ মনে করেন, কোন একটি দলের স্বার্থে ইভিএম এ ভোট গ্রহণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে, একটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে কাজ করা। আর কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা যারা নির্বাচন করে সেই সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা উচিত। আবার কোনো কেন্দ্রে ব্যালট আর কোনো কেন্দ্রে ইভিএম, এভাবে ভোটগ্রহণ হলে খুব খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হবে। আসলে ইভিএম এর দোষ নয়, আমাদের দেশের মানুষ ইভিএম এ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়।
বৈঠকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ইভিএমে যান্ত্রিক ত্রুটি হয়। এর কারণে ভোটে বিলম্বিত হয়। গোপন কক্ষে ক্ষমতাসীনরা প্রভাব বিস্তার করে জোর করে ভোট দিয়ে দেন অথবা বাতিল করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে এসেছে। মাত্র চারটি দেশ এখন ইভিএম ব্যবহার করে। ১৪টি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে। পাকিস্তান বিল পাস করেছে। ভারতেও কথা উঠছে ইভিএম নিয়ে। ইভিএম নিয়ে আপত্তি উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ইভিএম বর্জন করছে সেখানে বাংলাদেশ কেন ব্যবহার করছে? বাংলাদেশের মানুষ এখনো শিক্ষিত না।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) যুগ্ম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, ইভিএমে হার্ডওয়্যারের বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সফটওয়্যারের ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৮ সালে ভোটে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা ৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আমি সেই নির্বাচনের কো-অর্ডিনেটর ছিলাম, আমাদের অনেক পোলিং এজেন্ট ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে পারিনি।
সক্ষমতা না থাকলে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা ঠিক হবে না জানিয়ে জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, কিছু আসনে ব্যালট, বাকি আসনে ইভিএমে ভোট বৈষম্য তৈরি করবে।
সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যখন শপথ নিয়েছেন তখন বলেছেন, ‘অনুরোগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি সমান আচরণ করবো।’ দুই পদ্ধতিতে ভোট নিলে এই সমান আচরণটা কিন্তু আর থাকলো না। যদি ৩০০ আসনে আপনারা ইভিএমে ভোট নিতে পারেন তাহলে আপনাদের এই টেকনোলজি আমরা ব্যবহার করবো।
বাংলাদেশ মিশন টুলস ফ্যাক্টরির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, ইভিএমে কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু ইভিএমের ভোটের ফলাফল প্রকাশ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তিই শতভাগ সঠিক নয়। অনেকে উদাহরণ দিয়েছেন বিভিন্ন দেশ ইভিএম ব্যবহার করে না। কিন্তু একটু তথ্যে ভুল আছে। বেলজিয়ামে ইভিএম নিয়ে অনেকবার গিয়েছি। বেলজিয়াম ও অন্যান্য বড় সমস্যা হচ্ছে গোপনীয়তার ইস্যু। তারা কাউকে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও বায়োমেট্রিক ডাটা দিতে চায় না। আমি অনেক জায়গায় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। যে আপনারা কীভাবে এই ডাটাবেজ বানালেন। আমরা বলেছি, দিস ইজ ইলেকশন কমিশন। দিস ইজ এ বডি ইজ নট আন্ডার এনিবডি’।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন বাংলাদেশ মিশন টুলস ফ্যাক্টর থেকে ইভিএম নিতে চাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সভা শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ইভিএম নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বয়স্কদের ইভিএম ব্যবহারে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে না। তবে মোটা দাগে আমরা ইভিএম নিয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি।
এসএম/আরএডি/জিকেএস