তিনবার এমপি হলেও এলাকাবাসীর কাছে প্রায় অচেনা
ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ১৪৯ নম্বর আসন, ময়মনসিংহ-৪। ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এ আসনে সমশক্তিধর। স্বাধীনতার পর থেকে একেক সময় একেক সমীকরণে এখানে তিন দল থেকেই তিনবার করে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এ আসনটির বর্তমান এমপি একরকম ‘অপাঙক্তেয়’ হয়ে পড়েছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রমরমা রাজনীতি আর সিটি করপোরেশন গঠন ও স্থানীয় সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কাজের ভিড়ে ‘হারিয়ে গেছেন’ এমপি। কোনো কাজে নেই তার সম্পৃক্ততা, নেই কোনো কর্মসূচি। সাধারণ মানুষও জানেন না, এমপি কে! তার কোনো উত্তরসূরি বা নেতাকর্মীর খোঁজও মেলেনি।
১৫ থেকে ১৯ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহর ঘুরে এমপির তেমন কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়েনি। সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে একটি ফেস্টুন ও নামফলক ছাড়া চোখে পড়েনি কোনো ব্যানার-ফেস্টুন বা নামফলক। কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডেও নেই কোনো উপস্থিতি। তবে এর বিপরীতে সবখানে সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু, সাবেক মন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
শহরে ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় চরনিলক্ষিয়ার নুরুজ্জামানের সঙ্গে। ‘আপনাদের এলাকায় এমপি কে ভাই? এমন প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে বলেন, ‘এমপি কে, তা তো খেয়াল নাই। তবে মেয়রকে চিনি। আমাদের এখানে তিনিই সব। সব কাজে তারেই দেখি।’
রওশন এরশাদকে চেনেন কি না জানতে চাইলে হাসিমুখে নুরুজ্জামান বলেন, ‘চিনি। তার বাড়ি সুতিয়াখালী।’
তিনি কে? জানতে চাইলে জবাবে আবারও হাসি দেন। কিন্তু উত্তর দেননি। তিনিই তো আপনাদের এমপি, বলতেই বলেন, ‘ও হ্যাঁ। উনি তো এলাকায় আসেন না। ছবি-টবিতেও দেখি না। এমনিতে তার বাড়ি চিনি।’
ময়মনসিংহ সদরের পোস্টার-ফেস্টুনে মেয়র ইকরামুল হক টিটু ও সাবেক মন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে
শহরের কেওয়াটখালী রেলব্রিজের পাশে একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক মো. হেলাল উদ্দিন। তার সঙ্গে কথা হয় ঘুরতে ঘুরতে।
আপনাদের এলাকায় এমপি কে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রিন্সিপাল (প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান, সাবেক ধর্মমন্ত্রী)।’
তার এই ভুল শুধরে দিতেই জবাবে বলেন, ‘ও রওশন এরশাদ? উনি তো আহে না, খোঁজখবর নেন না। খোঁজখবর নেন প্রিন্সিপাল (সাবেক এমপি) সাব আর টিটু সাব (মেয়র)।’
মো. হেলাল উদ্দিন উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘আপনি ওদের (এমপির) এলাকায় গেছুইন? যায়া দেহুইনে যে। ওই যে এই এলাকার এমপি, ওর বাড়ি যে সুতিয়াখালী, অস্তিত্ব আছেনি দেহুইন যে। কাজকর্ম করে নাই। কোনো কিচ্ছু করে নাই। একটা হাসপাতাল বানাইছে, সেটাও বন্ধ। আমার যদি কোনো অবদান না থাকে, তাহলে কী লাভ?’
তিনি বলেন, ‘হেয় যে এমপি, পাস কইরা যে গেলো, এলাকায় আইছে অহনতরি জনগণের কাছে? ওর এলাকায় গিয়ে জিগ্যেস করেন। কেউ চিনেও না। অস্তিত্বও নাই।’
হেলালের দাবি, কোনো মিটিং-মিছিল বা কর্মসূচিতেও এমপিকে দেখা যায় না। করোনায় কোথাও ত্রাণ দিতেও দেখা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘দিলে (ত্রাণ) তো নামই হুনতাম। দিছে ছাত্র পোলাপানে, দিছে বিএনপির পোলাপানে, দিছে আওয়ামী লীগের পোলাপানে। কই হের নাম কই? এমপি কাজ করলে তো আঙ্গর এই বিভাগ আরও আগেই হইতো। বেশির ভাগ সময় তো এমপি ছিল রওশন এরশাদ। কাজ তো করছে আওয়ামী লীগে।’
স্থানীয় সাংবাদিক শৈবাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমপি সাহেব কালেভদ্রে এলে সার্কিট হাউজে ওঠেন। সেখানে এলাকার কিছু লোককে ডেকে সেলাই মেশিন বিতরণ করেন। আবার চলে যান।’
জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের পর থেকে এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (সাবেক ধর্মমন্ত্রী) দুইবার ও আব্দুল মালেক একবার। বিএনপি থেকেও তিনবার এমপি হয়েছেন। এর মধ্যে জয়নুল আবেদীন জায়েদী, এ কে এম ফজলুল হক ও দেলোয়ার হোসেন খান দুলু একবার করে। জাতীয় পার্টি থেকেও তিনবার এমপি হয়েছেন রওশন এরশাদ। বর্তমানে এমপি তিনিই।
রওশন এরশাদ ১৪ আগস্ট ২০২১ থেকে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে ব্যাংককে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যখন সুস্থ ছিলেন তখনও তাকে এলাকায় পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে তার আগমন স্বামী সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাত ধরেই। এরপর ওই আসন থেকে তিনি আবারও নির্বাচিত হন ২০১৪ সালে। তৃতীয়বারের মতো ওই আসন থেকে সংসদে আসেন ২০১৯ সালে।
ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদের সঙ্গে রওশন এরশাদ
২০১৬ সালের মার্চে জাতীয় পার্টির অষ্টম কাউন্সিলের পর দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হন তিনি। এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম কাউন্সিলে তাকে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক (চিফ প্যাট্রন) ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে তিনি ওই পদেই রয়েছেন। দলে নিজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে জাপার কো-চেয়ারম্যান করেন তিনি। তবে সরেজমিনে ময়মনসিংহ সদর ঘুরে কোথাও সাদ এরশাদের অস্তিত্বও চোখে পড়েনি। যদিও সাদ এরশাদ রংপুর-৩ আসনের এমপি।
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সদরের এমপি তো এখন অসুস্থ। দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন। সাধারণত এলাকায় আসেন না। রাষ্ট্রীয় বা দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায় না।’
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের কার্যনির্বাহী সদস্য তুহিন তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, সদরের এমপির বয়স হয়ে গেছে, উনি মুভ করতে পারেন না। ফলে মানুষের সঙ্গে তার কানেক্টিভিটি নেই। মানুষ তার চাওয়াটা বলতে পারছে না। তাছাড়া জাতীয় পার্টিরও কোনো পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটিও নেই। উনার অবর্তমানে প্রতিনিধিত্ব করার মতো লোকও নেই।
কিন্তু এলাকায় এমপির পদচারণা না থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান কার্যক্রম আছে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু ও সাবেক এমপি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান সমর্থিত নেতাকর্মীদের চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম আছে। জনসমর্থন কুড়াতে নানা ইতিবাচক কার্যক্রমে তাদের প্রতিযোগিতাও দৃশ্যমান।
এসইউজে/এমএইচআর/এসএইচএস/এইচএ/এএসএম