বিতর্কিতরাও চান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন!
দ্বিতীয় ধাপের আসন্ন ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ৪ হাজার ৪৫৮ জন প্রার্থী। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর পুত্র ও নাতি, বিএনপি নেতা, খুনের আসামি, নারী নির্যাতন মামলার আাসামিও রয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, বিধবা ভাতার কার্ড নিয়ে প্রতারণা এবং গরিবের চাল বিক্রি করে সমালোচিত চেয়ারম্যানরাও আছেন।
ইতোমধ্যে নানাভাবে স্থানীয় নেতা, সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা।
এদিকে মনোনয়ন পেতে জেলা সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাকিম হাওলাদারের স্বাক্ষর জাল করে কেন্দ্রে তালিকা পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম আউয়ালের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ‘ঝামেলা’ এড়াতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা চান না মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার এমপি-নেতারা। তারা লিখিতভাবে বিষয়টি দলীয় সভাপতিকে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক ডেকেছে আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবনে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপের ভোটে যারা নৌকা পেতে চান তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। নৌকা চান রোহিঙ্গাদের ভোটার করা চেয়ারম্যান, রাজাকারের নাতি, বিএনপি নেতা, নারী নির্যাতনের মামলার আসামি, সাংবাদিক নির্যাতনকারী, দুর্নীতি কমিশন-দুদকের মামলার আসামিও। একই সঙ্গে হত্যার মামলার আসামিও রয়েছেন। রয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনকারী নেতাকর্মীরাও।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা শরবত আলী মোল্যা হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ ডালিম। তিনি একই ইউপি থেকে ফের মনোনয়ন চান। অথচ তাকে ওই মামলায় পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। তার বাবা তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধী। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ অনেকগুলো মামলা আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কক্সাবাজারের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন আহমেদ পিন্স। তার বিরুদ্ধে দলীয় সভাপতির কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শামসুল আলম। পিন্সের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যাকারীদের মদদ প্রদান, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্রদানে প্রতিজন থেকে ১০ হাজার করে টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেছেন তিনি। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা রয়েছে। বির্তকিত এই ব্যক্তিকে নৌকা না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম হাওলাদারের স্বাক্ষর জাল করে কেন্দ্রে তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে জেলার সভাপতি একেএম আবদুল আউয়ালের স্বাক্ষরও রয়েছে। তবে জেলার সভাপতি এ নিয়ে মুখ খোলেননি। সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর জাল করার বিষয়টি প্রথমে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনকে জানিয়েছেন। পরে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম হাওলাদার অভিযোগ করেন, জেলা থেকে যে তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে সে তালিকায় আমি স্বাক্ষর করিনি। বিষয়টি নিয়ে জেলা সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামার্শ দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জেলা সভাপতি একেএম আবদুল আউয়ালকে একাধিকার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জামালপুর সদরের ২নং শরীফপুর ইউনিয়নের বিতর্কিত চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আলমও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। রফিকুল ইসলাম বিধবা কার্ড করে দেওয়ার প্রলোভনে স্থানীয়দের কাছ থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নেওয়া, গরীবের চাল টাকায় বিক্রিসহ নানা অভিযোগের কারণে এলাকায় বিতর্কিত। হনুফা বেওয়া (৬৫) নামের এক নারীর কাছ থেকে হাজার টাকা নিয়ে বিধবা কার্ড না দেওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তাকে মারধর করেন চেয়ারম্যান। গত বছরের ১১ আগস্ট ওই মারধরের ঘটনায় হনুফা থানায় অভিযোগও করেছেন। যেটি এলাকায় বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।
বান্দরবানের লামা উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা। তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদের কপিও যুক্ত করা হয়েছে। ছাচিং প্রু মারমার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জন্ম সনদ বাণিজ্য, ভূমিহীনদের ঘর দিতে ঘুষ নেওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, রাস্তা সংস্কারের টাকা আত্মসাৎ, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বিতরণে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় মামলাও হয়েছে।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি এর আগেও দুইবার একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু এবার তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় নাম নেই তার। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব থাকায় তাকে এই তালিকায় রাখা হয়নি বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে আলাদা অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন সালেহ উদ্দিন। সেই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, যারা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন, যারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছেন তাদের নামও প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি আমার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেক নেতার কাছেই গিয়েছি। কিন্তু কেউই আমার জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ করেননি। কেন করেননি তারাই ভালো বলতে পারবেন।
জানা গেছে, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কাপাসিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এম এ খালেক কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় তৃণমূলের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এম এ খালেক।
তিনি বলেন, কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমাকে পছন্দ করেন না। ওনার পছন্দের লোক হলেন টোক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ জলিল। এর আগেও এম এ জলিলকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি হেরে যান। এবারও তাকে মনোনয়ন দেওয়ার লক্ষ্যেই তৃণমূল তালিকা থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নবীদুলের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির সংবাদের কাটিং যুক্ত করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশীদুল হাসান রশীদের বিরুদ্ধেও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সুদের ব্যবসা, দলের ত্যাগী ও পুরোনো নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম ও হয়রানির অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ফিরোজ খান। তার বিরুদ্ধেও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ দেওয়া হয়েছে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানের কাছেও। লিখিত অভিযোগে ফিরোজ খানকে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি এবং তিনি রাজাকার পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোয়ারাবাজার ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আবুল মিয়া। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দেওয়া একটি লিখিত অভিযোগে আবুল মিয়াকে রাজাকারের নাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য বেশ স্পষ্ট। তারা বলছেন, ইউনিয়ন, থানা/উপজেলা এবং জেলা আওয়ামী লীগের রেজুলেশন এবং বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ থাকলেই নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক জাগো নিউজকে বলেন, কোনো বিতর্কিত, দাগি সন্ত্রাসী এবং জনপ্রিয়তা নেই এমন ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে না। যারা দুঃসময়ে ছিলেন তারাই বঙ্গবন্ধুর নৌকা পাবেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দলের প্রধানের নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। আমাদের কাজ হলো মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে বাকি মনোনয়ন প্রত্যাশী ও নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা।
দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৮ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী চার হাজার ৪৫৮ জন। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে ১১ জন মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। ১০ পৌরসভায় ৫৩ জন মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। একইসঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ১৯ জন।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এই বৈঠক শনিবার পর্যন্ত গড়াতে পারে। বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের উপ-নির্বাচন, পৌরসভার ও উপজেলার প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। শুক্র ও শনিবার ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
এসইউজে/ইএ/জিকেএস