বুদ্ধিজীবী হত্যার কলঙ্ক


প্রকাশিত: ০২:৫৩ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বিএনপি সরকার এবং বিএনপি জোট সরকার তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের দীর্ঘ শাসনকালে অকাট মূর্খের মতো কতগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরা। বলা ভাল, এরা চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বা মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে না পারে। এর গৌরবগাথা পড়ে নতুনভাবে প্রাণিত হতে না পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদে জ্বলে উঠতে না পারে। আর চারপাশে চড়ে বেড়ানো স্বাধীনতা প্রত্যাশী বাঙালির হত্যাকারীরা হাতের রক্ত ধুয়ে যাতে স্বাধীন দেশের ক্ষমতার ভাগ নির্বিঘ্নে নিতে কোনো প্রতিরোধের মুখে না পড়ে।

দুর্ভাগ্য এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী,  যুদ্ধাপরাধী এবং বাঙালি হত্যাকারী, নারী নির্যাতনের দোসর আর বিজয়ের পূর্বক্ষণে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী যারা, তাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের স্মৃতিচারণে এ এক কলঙ্কের তিলক হয়ে রইল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে যারা গলাটিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সেই জামায়াতে ইসলামী এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর বাহিনীর নেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এভাবে লাঞ্ছিত করলেন শুধু নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে। আর এই খুনি অপরাধীদের পালকের নিচে রেখে বলবন্ত করে তুললেন জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি বিএনপি নেতানেত্রীরা। এতে ক্ষমতার আস্বাদ পাওয়ার স্থূল উদ্দেশ্য হয়ত কিছুটা সাধিত হয়েছে, তবে এর বিনিময়ে বিএনপিকে মূল্য দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। ইতিহাসে নিজেদের কলঙ্কিত অবস্থান পাকা করে রাখছে। ইতিহাস বোধ আর প্রজ্ঞা দিয়ে বিবেচনা করলে যে কেউ বিশ্বাস করবেন, ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ইতিহাসের সত্য মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। যেমন প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর এলেই মানুষের ঘৃণা আছড়ে পড়ে আলবদর বাহিনীর খুনিদের দিকে।

পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞের কথা এখানে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি না। বর্তমান লেখায় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পক ও নায়কদের অন্তর্গত উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে সামান্য নিবেদন করতে চাই। ইংরেজ শাসকদের মত না হলেও স্বভাবে ঔপনিবেশিক চরিত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের। কিন্তু পার্থক্য যা তা হচ্ছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের মধ্যে ছিল আভিজাত্যের আচরণ আর পাকিস্তানিদের মধ্যে বর্বর মানসিকতা। ইংরেজরা পৃথিবী জুড়েই এক সময় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এদের নীতি অনুযায়ী উপনিবেশে দীর্ঘদিন শাসন-শোষণ করেছিল ঠিকই তবে বিদায়ের আগে সে দেশের নেতা নেত্রীদের সাথে বসে কীভাবে তারা দেশ পরিচালনা করবে এর একটি বিধি ব্যবস্থা করে দিয়ে যেত। এটিকে তারা নিজেদের দায়িত্বের অংশ বলেই মনে করতো। ইংরেজ শাসকদের ভারত ছাড়ার আগে আমরাও প্রত্যক্ষ করেছি। বঙ্গভঙ্গের মধ্যদিয়ে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। মুসলমান আর হিন্দু নেতৃত্বে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না। তাই দেশ ছাড়ার আগে মুসলিম নেতৃবর্গ নিজেদের জন্য একটি আলাদা দেশ চায়। এই ইস্যুতে হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবর্গের সাথে দীর্ঘ আলাপ করে ইংরেজ শাসকরা ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো আলাদা দেশ দিয়ে যায়।

পাশাপাশি পাকিস্তানিরা কেমন আচরণ করলো বাঙালির সাথে? পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্বপাকিস্তানের মানুষকে প্রতারিত করেছে পরিকল্পনামাফিক। ধর্মের দোহাই দিয়ে আবেগে মুহ্যমান করে রাখতে চেয়েছিল মুসলমান বাঙালিকে। মানতে হবে, ক্ষমতাসীন কূটকুশলী পাকিস্তানি নেতৃত্ব এটুকু বুঝেছিল দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করা বাংলার মানুষ অধিকার সচেতন। তাই পরবর্তী বাঙালি প্রজন্ম যাতে আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক শক্তি এবং ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থাটি নিতে হবে শুরুতেই। সে উদ্দেশ্য ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই সব কিছু বাদ দিয়ে ভাষা প্রশ্নে জড়িয়ে পড়েছিল শাসকগোষ্ঠী। তারা বিবেচনা করেছিল, ভাষা যেহেতু সাহিত্য আর সংস্কৃতির বাহন, তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বাংলা শুধু মুখের ভাষায় আটকে থাকবে। উর্দুচর্চা করে পরবর্তী বাঙালি প্রজন্ম বাংলারধ্রুপদী সাহিত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এভাবে তারা নতজানু হয়ে পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুভাষী নেতাদের সামনে এবং বাঙালি আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হবে। কিন্তু স্থূলবুদ্ধিতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

স্থূলবুদ্ধির পাকিস্তানি শাসকদের তর সইছিল না। নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য বাঙালির দীর্ঘদিনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সংগ্রামী ঐতিহ্য আমলে না এনে নতুন দেশের জন্মলগ্নেই ভাষা প্রশ্নে জটিল বিতর্ক তৈরি করে ফেলল। বায়ান্নের প্রবল ঝাঁকুনির পরও বোধোদয় হলো না। বাঙালিকে পদদলিত করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করল। কেড়ে নিতে থাকল তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। তাই যে বাঙালি ১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাবের পরে অন্তরের আকুতি থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনে নেমেছিল। আর তা দেখে বাঙালিদের উদ্দেশ্য ব্যঙ্গ করে হিন্দু পত্রিকাগুলো লিখেছিল, ‘হাত মে বিড়ি মু মে  পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, সেই বাঙালিই সময়ের বাস্তবতায় আইউব শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো। মুসলমান ভাই, বলে শাসন করতে আসা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ভেতরকার প্রতারকের চেহারাটি ততক্ষণে স্পষ্ট বাঙালির কাছে। অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বদলে শাসকরা নির্যাতকের কুৎসিত হাত প্রসারিত করল। যে বাঙালি সাধের পাকিস্তান গড়তে অগ্রণী ছিল। এবার মোহভঙ্গের পর তারা স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে উত্তাল আন্দোলন গড়ে তুলল।

১৯৫৪-এর নির্বাচনের পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী বুঝেছিল, মুসলিম লীগ দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা সম্ভব নয়। পূর্বপাকিস্তানে মুসলিম লীগ তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই এখন শেষ রক্ষা পেতে হলে অন্ধকার পথে হাঁটতে হবে। তাই মুসলিম লীগ স্বার্থপূরণের যথেষ্ট যোগ্য নয়, বুঝতে পেরে অন্ধকারের জীব খুঁজতে মনোযোগ দিল তারা। শাসকদের এ বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এ দেশের স্বল্প শিক্ষিত আর অশিক্ষিত মুসলমান যথেষ্ট ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে এই কোমল জায়গাটিকে প্রতারণা করে তাদের বিভ্রান্ত করে ফেলতে হবে। আর এ কাজে মওদুদীবাদের তালিম নেয়া জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে আর যোগ্য কে! ফলে পাকিস্তানি শাসকরা জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামী নামধারী গোষ্ঠীকে কানপড়া দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেয়। এর ধারাবাহিকতাতেই জামায়াত আর ইসলামী নামধারী তার সহযোগীরা বাঙালি নিধন, নারী ধর্ষণ ও সম্পদ ধ্বংসে পাকবাহিনীর একান্ত দোসর হয়ে গেল। সবচেয়ে বড় ইসলামবিরোধী কাজগুলো করতে লাগল প্রতারকের মতো ইসলামের দোহাই দিয়ে। ধর্মীয় আবেগকে উস্কে দিয়ে জেনে শুনে মিথ্যাচারের মাধ্যমে এই প্রতারণার ফাঁদ এখনো পেতে চলছে তারা।

একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকরা না হয় পূর্ব পাকিস্তানের মাটিটুকু যাতে হাতছাড়া না হয় তাই গণহত্যা, নারী নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। আর এদের অপকর্মে সহযোগিতা করেছিল জামায়াত ও সমমনা ইসলামী দল পরিচালিত রাজাকার, আলবদর, আলশামসের তরুণ তুর্কিরা। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর আলবদরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা নয়, শত্রু ‘হিন্দু’ নয় শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক এবং এ ধারার নিরীহ বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করা হলো কেন? আর হত্যা করা হলো এমন এক সময়, যখন পাকিস্তানি জান্তার পরাজয় মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। যেহেতু বুদ্ধিজীবী হত্যা পাকিস্তানি শাসকদের যুদ্ধ জয়ে প্রভাব ফেলবে না, তাই এখানে ‘গাজী’ হওয়া বা ‘শহীদ’ হওয়ার কেনো গৌরব নেই। যুদ্ধাবস্থায় প্রতিপক্ষকে হত্যা করায় পাপ নেই বলারও সুযোগ নেই।

পরাজয় মেনে আত্মসমর্পণের পূর্বক্ষণে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিক সহস্রাধিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা খুন করল। যে খুনে-বাহিনীর নেতারা দুর্বৃত্ত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় আবার এ দেশের মাটিতে রাজনীতি করছেন, মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর বাহিনী তথা জামায়াত যে এ দেশকে কখনো ভালবাসেনি বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্যদিয়ে তারা এর প্রমাণ রেখেছে। কারণ তারা যখন বুঝতে পারল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার, তাই এই নতুন দেশটি গড়ে তুলতে, এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে প্রধান চালিকা শক্তি হবেন বুদ্ধিজীবী সমাজ। ফলে স্বাধীনতা পেলেও বাঙালি যাতে পঙ্গু হয়ে যায় এ কারণে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলতে হবে। আর এই ভয়ঙ্কর হত্যাকারীরা এমন পৈশাচিক উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করল ১৪ ডিসেম্বর।

বিএনপিকে কলঙ্কিত করে তাদের ঘাড়ে বসে জামায়াত আর তাদের আলবদর কমান্ডাররা পেশিশক্তি বাড়িয়েছে অনেক। কর্মদোষে এদের আশ্রয়দাতাসহ মানবতা বিরোধী জামায়াত নেতা ও তাদের দল এখন অনেকটা কোণঠাসা। এদের জানা উচিত ১৪ ডিসেম্বর প্রতি বছরই ফিরে আসবে। যতই বিকৃত করা হোক, ইতিহাস তার স্বয়ংক্রিয় পথে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করবেই। গণহত্যার দোসর আর বুদ্ধিজীবী হত্যার খলনায়করা কারো আশ্রয়েই শেষ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। জঙ্গীবাদ উস্কে দিয়ে নয়- শুধু অপরাধ স্বীকার করে জাতির কাছে করজোরে ক্ষমা ভিক্ষার মধ্যদিয়ে যদি কিছুটা পাপঙ্খলন করা যায়, এটুকুকেই প্রাপ্তি মানতে হবে। এই বাস্তব বোধোদয় কি এদের হবে? পাকিস্তানি চক্রান্তে এদেশীয় আলবদর নামের খুনিরা আমাদের সূর্যসন্তানদের হত্যা করে নবীন দেশ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথকে ব্যাহত করেছে ঠিকই কিন্তু গতি থামাতে পারেনি। এদের উত্তরসূরিরা সহস্ত্রগুণে বেড়ে উঠছে। জঙ্গীবাদ আর মৌলবাদের দীক্ষা দিয়ে যতই অন্ধকার নামানোর চেষ্টা করা হোক না কেন দেশপ্রেমের সূর্য রশ্মিতে চারপাশ আলোকিত হবেই!

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।