উন্নয়নকামী বাংলাদেশ ও পরাক্রমশালী আমলাতন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪৯ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫

রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে ক্যাডার সার্ভিসের হাতে। এ সার্ভিসের কেন্দ্রে রয়েছে সচিবালয় যেখানে রাষ্ট্রের সকল মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারণী ও দাপ্তরিক কার্য সম্পাদিত হয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয় অনেকগুলো অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত। দেশে বর্তমানে ক্যাডারের সংখ্যা ২৮টি। প্রত্যেকটি ক্যাডারেরই সচিবালয় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত নিজস্ব লাইন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কিংবা পরিদপ্তর রয়েছে। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হলো একমাত্র পররাষ্ট্র ক্যাডার ব্যতিত জন্মলগ্ন থেকে সকল মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের নেতৃত্বে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কর্ম সম্পাদনের জন্য সচিবালয়ে ক্যাডারভুক্ত ছয়টি পদবি রয়েছে। এ পদবিগুলো হল- সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব। উপসচিব থেকে সচিব কিংবা নবসৃষ্ট সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদসমূহ সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) নামে পরিচিত। সিনিয়র সার্ভিস পুল-এর পদসমূহ এবং অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের নেতৃত্বস্থানীয় পদসমূহে প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ২৬টি ক্যাডারের সাথে দীর্ঘদিন যাবত আন্তঃক্যাডার অসন্তোষ চলে আসছে। ক্যাডার সার্ভিসে বহুবিধ সমস্যা থাকলেও আমি এখানে শুধু দু’টি বিষয়-নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে আলোচনা করব।  

ক্যাডার সার্ভিসের জন্মলগ্ন থেকে পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হয় যোগদানের সময় সরকারী কর্মকমিশন কর্তৃক আয়োজিত নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল ও মেধাতালিকার ভিত্তিতে। চাকরিতে যোগদানের পর সকল কর্মকর্তাকে কর্ম কমিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য বিভাগীয় পরীক্ষা ও প্রথম পদোন্নতির জন্য সিনিয়র সার্ভিস পরীক্ষা ছাড়া ঊর্ধ্বমুখি পদোন্নতি বা পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও মেধা প্রমাণের জন্য আর কোনো ধরনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় না। অনুগত থাকার জন্য বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কোনো বিরূপ মন্তব্য এবং কোনো বিভাগীয় মামলা না থাকলে শূন্যপদের বিপরীতে চাকরিতে যোগদানকালীন নির্ধারিত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন অনেক ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর অধীনস্ত কর্মকর্তাকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। উন্নত বিশ্বের সর্বত্র দক্ষতার ভিত্তিতে সরকারী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয়ে থাকে।

মেধা যাচাইয়ের প্রতিযোগিতা না থাকায় এবং একাডেমিক ক্যারিয়ার, কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করে পদায়ন না করার কারণে প্রশাসন ক্যাডার মেধা সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ‘শুদ্ধ ফাইল খুব কমই পাওয়া যায়`- এমন মন্তব্য করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১৬ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেন, `বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের পড়ালেখা ও দক্ষতার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এখনই নজর দেয়া দরকার` (দৈনিক সংবাদ, ০১ অক্টোবর, ২০১৫)। সাবেক অর্থসচিব ড. আকবর আলী খান তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Gresham’s Law Syndrome and Beyond: An Analysis of Bangladesh Bureaucracy (2015) বইতে বলেন- বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র পৃথিবীর অন্যতম ‘অকার্যকর আমলাতন্ত্র’ এবং দক্ষিণ এশিয়ার র‌্যাংকিং এ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের অবস্থান অন্য সব দেশের নিচে।   

চাকরীবিধি অনুযায়ী একজন ক্যাডার কর্মকর্তা চার বছর চাকরি পূর্ণ করলে প্রথম পদোন্নতি এবং ১০ বছর চাকরি পূর্ণ করার পর উপসচিব পদমর্যাদার পদে নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করেন। উপসচিব পদ থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত পদে ন্যূনতম তিন বছর চাকরি পূর্ণ করার আবশ্যকতা রয়েছে। যুগ্ম সচিব হতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত পদে ন্যূনতম দুই বছর চাকরি পূর্ণ করার আবশ্যকতা রয়েছে। সে হিসেবে একজন ক্যাডার কর্মকর্তা ১৫ বছর পর গ্রেড-১ এ পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পদের চেয়ে অতিরিক্ত নিয়োগ এবং ২৬টি ক্যাডারের উপর প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণের কারণে গ্রেড-১ আসতে কখনো কখনো ২২-২৫ বছর লেগে যায়। আবার অনেকেই গ্রেড-১ এ আসার আগেই অবসরে চলে যেতে বাধ্য হন। অভিযোগ রয়েছে যে, সচিবালয়ের সব প্রশাসনিক কাজ-নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদির দায়িত্ব প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা সময়মত পদোন্নতি পান না।

অন্যদিকে পদ শুন্য না থাকলেও প্রশাসন ক্যাডার নিজেদের জন্য বিশেষ নীতিমালা তৈরি করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করার কারণে ক্যাডার সার্ভিসের পিরামিড ব্যবস্থা (অর্গানোগ্রাম) ভেঙ্গে পড়েছে। প্রশাসনে উচ্চ-মধ্য পর্যায়ে নির্ধারিত পদের দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। আর নিম্নস্তরে দেখা দিয়েছে কর্মকর্তা সঙ্কট। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত সিনিয়র সচিব/সচিবের ৮৭টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৭২ জন, ১০৮টি অতিরিক্ত সচিব পদের বিপরীতে ৪২২ জন, যুগ্ম সচিবের ৪৩০টি পদের বিপরীতে ৯১৩ জন, উপসচিবের ৮৩০টি পদের বিপরীতে ১২৯৮ জন। বিপরীতক্রমে সিনিয়র সহকারী সচিবের ২৭০০টি পদের বিপরীতে ১৩৮৯ জন এবং সহকারী সচিবের ১৭১৬টি পদের বিপরীতে ১৪২৯ জন কর্মকর্তা কর্মরত আছেন (দৈনিক সংবাদ ০১ অক্টোবর, ২০১৫; দৈনিক যুগান্তর ০৩ মে, ২০১৫)। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব- এ তিন স্তরে অনুমোদিত পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন, আবার পদোন্নতির কারণে নিচের স্তরে অর্থাৎ সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মধ্যম স্তরে কর্মকর্তার সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কাঠামো হিসেবে দেখলে এটা ভারসাম্যহীন ‘পেটমোটা’ প্রশাসনে রূপ নিয়েছে। পদ খালি না থাকায় পদোন্নতি পাওয়ার পরও অনেক কর্মকর্তাকে নিচের পদে (ইনসিটো) কাজ করতে হচ্ছে। উপরের দিকে পদের চেয়ে ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ায় সচিবালয়ে কাজের গতি কমে গেছে। বর্তমানে সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে বাকি ২৬টি ক্যাডারের ক্ষেত্রে তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। একই ব্যাচে যোগদানকারী ২৬টি ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তাই যোগদানের কয় বছরের মাথায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে জুনিয়র হয়ে যান। অথচ পিএসসির মেধা তালিকায় এরা অনেকেই প্রশাসন ক্যাডারের অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। সরকারী কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক সচিব ড. সা`দত হোসেন গত ৯ অক্টোর অক্টোবর সময় টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন বিসিএস পরীক্ষায় ভাল প্রার্থীদের ৮৫-৯০% বিসিএস (পররাষ্ট্র) এ যায়। আর বাকি ১০-১৫% কাস্টমস, পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ বাস্তবতায় কীভাবে নিজেদের ক্ষমতাকে আকাশের সীমানায় নিয়ে যান, কীভাবে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সমগোত্রীয় ২৬টি ক্যাডারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন? ২৬টি ক্যাডারে সময়মত পদোন্নতি না পাওয়ায় নতুন নিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ৩৬তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে মোট ৫৪২টি পদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ২৫০টি, পুলিশ ক্যাডারে ১২০টি, কর ক্যাডারে ৪৩টি, তথ্য ক্যাডারে ৩৭টি, সমবায় ক্যাডারে ২২টি, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২০টি, আনসার ক্যাডারে ১৯টি, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে ১৫টি, খাদ্য ক্যাডারে সাতটি, ইকোনমিক ক্যাডারে চারটি, ডাক-এ দুটি এবং পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে একটিমাত্র পদ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে যে প্রশাসন ক্যাডার সচিবালয় কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় থাকার কারণে অবস্থানগত সুবিধাপ্রাপ্ত অন্যদিকে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে একত্রিত হতে পারে না। এ অবস্থায় অন্য ক্যাডারের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য প্রশাসন ক্যাডার সব সময় নিজেদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি এবং জনবল বাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে। ক্যাডার সার্ভিসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নতুন পদ সৃষ্টি এবং নিয়োগে অসমতার এরূপ চিত্রই ফুটে উঠবে। এ অবস্থা রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়নের পরিপন্থী। বর্তমানে সরকার দিন দিন করের আওতা বাড়াচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় কর ক্যাডারে পদ চাহিদা অনেক কম। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদসহ নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলায় বর্তমান আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পুলিশ ক্যাডারে চাহিদা আরো অনেক বেশি থাকা উচিৎ। জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশে শান্তিকালীন প্রতি ৪০০ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য থাকাকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। উন্নত দেশগুলোয় ৪০০ জনের চেয়েও কম জনসংখ্যার বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য থাকলেও বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও পুলিশের অনুপাত ১০৩২:১ জন । একইভাবে মন্ত্রণালয়সমূহের প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণ ও বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বিসিএস (ইকনমিক) ক্যাডারের হলেও এ ক্যাডারে পর্যাপ্ত কর্মকর্তা নেই এবং সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতেও মাত্র চারটি পদের চাহিদা প্রদান করা হয়েছে।    

আমরা অত্যন্ত আশাবাদী যে আমাদের সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যবর্তী আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের অংশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের বাধাসমূহও চিহ্নিত হওয়া জরুরি। বর্তমান ক্যাডার সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া কখনো দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই জনগণের অর্থের অপব্যবহার ও অপচয় রোধ করে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্যাডার সার্ভিসের সংস্কার ও ভারসাম্য আশু প্রয়োজন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তালিন বিশ্ববিদ্যালয়, এস্তোনিয়া     

www.mainuddinnt.wordpress.com

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।