ইসির বিরুদ্ধে মামলা করার হুঁশিয়ারি শাহাদাতের
জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেয়া, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা এবং নির্বাচনী ফলাফলের নির্ধারিত প্রিন্টেড কপির পরিবর্তে সাদা কাগজের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছেমত ফলাফল লিখে নৌকার প্রার্থীকে অস্বাভাবিক ভোট দেখিয়ে বিজয় ঘোষণা করায় নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টায় নগরের নাসিমন ভবনে অবস্থিত দলীয় কার্যালয় মাঠে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।
লিখিত বক্তব্যে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই দিন নির্বাচনের নামে চট্টগ্রামের ইতিহাসে ভোট লুঠের মহোৎসব ও সহিংসতার একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
‘নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে সরকারের নীল নকশার অংশ হিসেবে প্রতিটি থানায় বিএনপি নেতা ও ধানের শীষের সমর্থক এবং এজেন্টদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের করা, আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ প্রশাসন যৌথভাবে নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি, বিনা কারণে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দায়ের করার মাধ্যমে ভোটারদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। শুধু ভোটার নয়, বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলরদের নির্বাচনের আগে এলাকা ছেড়ে যেতে হুমকি দেয়। যে বিষয়গুলো বারবার আমরা আপনাদের অবহিত করেছিলাম। আপনারা রিপোর্টও করেছেন।’
এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সুদূর পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে ভোটের আগের দিন রাত থেকে প্রতিটি এলাকায় বহিরাগতদের জড়ো করে সশস্ত্র মহড়া ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, ‘চসিক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে আপনাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই যে, এই নির্বাচনে ধানের শীষের বিপরীতে নৌকা প্রতীকের পাওয়া ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট আর ধানের শীষের ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। ৩ লাখ ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থীকে মেয়র ঘোষণা করা হয়েছে। রাত পৌনে ২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেল, এই নির্বাচনে মাত্র সাড়ে ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। যেটা বাস্তবিক অর্থে ছিল ৭.৫ শতাংশ।’
ইভিএমে ফল প্রকাশ হতে দেরি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাহাদাত বলেন, ‘বহুল বিতর্কিত ইভিএমে ভোটাভুটি হয়েছে। ভোটের ফলাফল পেতে সেই সনাতন পদ্ধতির চেয়েও বেশি সময় কেন লাগল তা আমাদের কেন, সব সচেতন মানুষের কাছে এক বড় রহস্য। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল ইভিএম পদ্ধতিতে একটি নগর ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে সময় লাগলো ১০ ঘণ্টা। কিন্তু কেন? সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’
‘আপনারা নিজেরাই দেখেছেন ভোটের দিন নগরীর প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে কীভাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা সকাল থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। জেলার মীরসরাই, বোয়ালখালী, রাউজান, ফটিকছড়ি, সাতকানিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে লাইনে দাড় করিয়ে দেয়।’
‘এসব বহিরাগতের অনেকে প্রিসাইডিং অফিসারের সহায়তায় ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেরা ইভিএম মেশিনের বোতাম টিপে নৌকার ভোট নিশ্চিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার পর ব্যালট প্যানেলে নৌকার প্রতীকে নিজেরাই চাপ দিয়ে দেয়। অনেক থানার ওসির নির্দেশে মেয়র প্রার্থীর জন্য রক্ষিত ইভিএম মেশিন ভোটকেন্দ্রের গোপন বুথ থেকে বাইরে এনে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার নজির সৃষ্টি করেছে’ বলেন বিএনপি প্রার্থী।
কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সকালে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসাররা ধানের শীষের এজেন্ট কার্ডে স্বাক্ষর না করে অসহযোগিতা করেন। নির্বাচন বিধি অনুযায়ী ভোটগ্রহণ শেষে গণনার পর প্রতিটি কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করার নিয়ম থাকলেও এবারের নির্বাচনে তা করা হয়নি।’
‘পাঁচলাইশ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চালিতাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষের ১১ জন এজেন্ট কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার পর বায়েজিদ থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাদেরকে ডেকে নিয়ে একটি কক্ষে বাইরে তালা দিয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রাখে।’
বিগত নির্বাচনের উদাহরণ তুলে ধরে শাহাদাত বলেন, ‘১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে একবছর আগে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আরিফুল ইসলাম ডিউক পাঁচ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তার ভোট দেখানো হয়েছে ৩৩৪টি। একইভাবে দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের ইয়াছিন চৌধুরী আশু, মোহরা ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আজম, পাথরঘাটা ওয়ার্ডের ইসমাইল বালিসহ অনেক জনপ্রিয় কাউন্সিলর ছিলেন, তাদের প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছে মাত্র দুই থেকে তিনশ ভোট।’
‘এছাড়া এলাকাভেদে ভোটের ব্যবধান ছিল অস্বাভাবিক। কোনো কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের হার দেখানো হয়েছে ১ শতাংশ এবং কোনো কেন্দ্রে এলাকায় ৯৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে হালিশহর আহমদ মিয়া সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। সেখানে ভোটার ২ হাজার ৩৬৫ জন। ভোট পড়েছে মাত্র ৪২টি। সবচেয়ে অস্বাভাবিক বেশি ভোট দেখানো হয়েছে দক্ষিণ হালিশহর ও রামপুর ওয়ার্ডে। দক্ষিণ হালিশহর এহসানউল উলুম আরাবিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে। এ কেন্দ্রে ভোটার ৩ হাজার ১০৮ জন, ভোটের হার দেখানো হয়েছে ৯৩.৮২ শতাংশ। রামপুর ওয়ার্ডের ঈদগাহ বড়পুকুর পাড় চিটাগাং লিবার্টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোটের হার ৯০.৯৬ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ, র্যাব ডিজিএফআই প্রধানসহ প্রশাসনের প্রায় সব কর্মকর্তা চট্টগ্রামে উপস্থিত থেকে প্রশাসনিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভোট লুঠ করেছে। কেন্দ্রে দায়িত্ব পাওয়া অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এজেন্টদের বের করে দেয়ার সময় বলেছেন তারা ওপরের নির্দেশ পালন করছেন।’
শাহাদাত বলেন, ‘আমি বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি, বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। কিন্তু ভোট দেখানো হয়েছে ২২.৫২ শতাংশ। আমার প্রশ্ন হলো- দুঘণ্টার মধ্যে এতো ভোট কোত্থেকে এলো? এতে বুঝা যাচ্ছে প্রিসাইডিং অফিসারের ১৫ শতাংশ ভোটদানের ক্ষমতা নৌকার পক্ষে কাজে লাগিয়েছে।’
‘৭৩৩টি কেন্দ্রে আমার ভোট দেখানো হয়েছে মোট ৫২ হাজার ৪৮৯টি। এর মধ্যে ১৮৭টি কেন্দ্রে দেখানো হয়েছে ১০ ভোটেরও কম। দুটি কেন্দ্রে শূন্যভোট। আমার নিজের কেন্দ্রে ভোট দেখানো হয়েছে ১৫টি। ষোলশহর বন গবেষণাগার উচ্চ বিদ্যালয় মহিলা কেন্দ্রে ও নাজিরিয়া নঈমিয়া মাহমুদিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে শূন্যভোট দেখানো হয়েছে ধানের শীষ প্রতীকে। বাকলিয়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে মোট ৩টি কেন্দ্রে রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ কেন্দ্র দুটি ও মহিলা কেন্দ্র একটি। তিন কেন্দ্রে মোট ভোটার ৯ হাজার ৭৩৪ ভোট। ধানের শীষের ভোট দেখানো হয় মাত্র ৪৪টি। এসব তথ্য আমাদের নিজস্ব ইলেকশন মনিটরিং সেল এবং আপনারা সাংবাদিক বন্ধুরা নিজেরা সরেজমিন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে যে রিপোর্ট করেছেন তার ভিত্তিতে কিছুটা তুলে ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও ঢাকার সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সদ্য-সমাপ্ত চসিক নির্বাচনে সংঘর্ষ, গুলি বিনিময়, প্রাণহানির ঘটনা, ককটেল বিস্ফোরণসহ পুরো নির্বাচনের যে খণ্ডিত চিত্র উঠে এসেছে, সেই সব সংবাদের আলোকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কিছুদিন আগে ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কমিশনের প্রতি যে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এবং বিচার দাবি করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র দিয়েছেন তার যৌক্তিকতার আবারও বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেরাই প্রমাণ দিয়েছেন।’
নির্বাচন কমিশন সচিবের বক্তব্য প্রসঙ্গে শাহাদাত বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র হিসেবে নির্বাচন কমিশন সচিব বক্তব্য দেন। তার বক্তব্য কমিশনেরই বক্তব্য। ভোটের আগের দিন নির্বাচন কমিশন সচিব সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, চট্টগ্রামে একটি ভালো নির্বাচন দেখবেন। ভোট পরবর্তী মূল্যায়নে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বলবো, ভালো নির্বাচন হয়েছে।’ একটি সংঘাতময় ও প্রাণহরণ এবং রক্তক্ষয়ী নির্বাচনের শেষে কমিশন সচিব বরাবরের মতো তুষ্টির ঢেঁকুর তুলেছেন। সহিংসতা বিষয়ে সচিব বলেছেন, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের নির্বাচনে কিছু ঘটনা ঘটে। সেই হিসেবে যদি বলেন, তাহলে বলবো, বরং কমই হয়েছে। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামিম, নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
আবু আজাদ/এআরএ/এএসএম