‘হাইজ্যাকের’ কবলে বিএনপি!

খালিদ হোসেন
খালিদ হোসেন খালিদ হোসেন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২০ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে নানা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টি খুবই কার্যকর হয়ে পড়েছে। দলের বড় একটি অংশই মনে করেন বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব সরকারের সঙ্গে আপস করে রাজনীতি করছে। যার ফলে সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের অনেক শীর্ষ নেতাও এটি মনে করেন। ফলে বিএনপির ওইসব নেতা ও ২০ দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতা মিলে নানাভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

বিএনপির অভ্যন্তরে যেমন চলছে বিশ্বাস আর আস্থাহীনতা, ঠিক তেমনই অবস্থা বিরাজ করছে দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যেও। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানাভাবে।

গত সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন নিয়ে যখন বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপি ও তার জোট শরিকদের কয়েকজন মিলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হঠাৎ পল্টন মোড়ে জমায়েত হয়। জানা যায়, আন্দোলনকারীদের ধারণা ছিল, তারা বেশকিছু সময় সেখানে টিকে থাকতে পারলেই অনেক শক্তি চারপাশ থেকে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করবে। সংগঠকরা হয়তো ভেবেছিলেন এরপর জনস্রোতের মধ্য দিয়ে অবস্থান দীর্ঘ হলেই সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে।

তাদের এই কর্মসূচি সম্পর্কে জানতেন না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে, দুই-একদিন আগে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অনুমান করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা তৃণমূলে বার্তা দেন, তারা যেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে এ ধরনের কর্মসূচি হবে হঠকারী। আর তার ফলে দল আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২০১৩-১৪ সালের ভুল আন্দোলনের মাশুল এখনও দলকে টানতে হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এইসব হঠকারী আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এসব কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে রয়েছেন বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, শওকত মাহমুদ, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফৎ ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব সদ্য প্রয়াত নুর হোসাইন কাসেমী। আর জামায়াতে ইসলামী ও এইসব নেতাদের মাঝে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে ২০ দলীয় জোট শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। তারা সবাই বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছন।

সূত্র জানায়, এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতাদের মৌন সমর্থন রয়েছে। পাশাপাশি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদসহ বিএনপির ভেতর থাকা সাবেক সেনাকর্মকর্তাদের প্রায় সবারই এতে সমর্থন রয়েছে।

চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বিএনপি যখন কোনো কর্মসূচি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন মৎস্যভবন চত্বরে সমাবেশ করেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। সেই সমাবেশেও মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী ও তার বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী ছিলেন। গত সোমবার দুপুরের সমাবেশেও মিয়তে উলামায়ে ইসলামের (কাসেমী) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও তার কিছু অনুসারীও অংশ নেন।

জমিয়তের একাধিক নেতা জানান, দলের নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমীর উৎসাহেই মাওলানা আফেন্দী তার অনুসারীদের নিয়ে পুরানা পল্টন এলাকায় অবস্থান করেছেন।

অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই একসময়ের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে ১/১১-এর সময় জেনারেল ইবরাহিমের সহযোগী ছিলেন। আর মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান একসময় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিবেরও দায়িত্ব পালন করেছেন।

সোমবার পল্টন-গুলিস্তান এলাকার বিক্ষোভের বিষয়টি ছিল শীর্ষ নেতৃত্বের অবগতির বাইরে। একইসঙ্গে এই বিক্ষোভের বিষয়টিও রহস্যজনক বলে মনে করছেন তারা। দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব তাদের কার্যক্রম পছন্দ করেননি। বিশেষত, বিক্ষোভের সঙ্গে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিষয়ে হাইকমান্ডের নেতিবাচক অবস্থান ছিল। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছেন, এমন কয়েকজন নেতাও শীর্ষ নেতৃত্বের নজরদারিতে রয়েছেন, এমন দাবি করেছেন কেউ কেউ।

ইতোমধ্যেই শওকত মাহামুদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমদ কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।

রিজভীর ভাষ্য, সংগঠনপরিপন্থী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

হাফিজ উদ্দিন আহমেদ আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সার্বিক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন।

দলের এই হঠকারী কর্মসূচি পালনে জড়িত নেতাদের বিষয় নিয়ে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামের এক নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা বিএনপির ব্যানারে এসব হঠকারী কর্মসূচি পালন করে নিজেদেরকে জাহির করতে চাইছে, এরা তো সুবিধাবাদী। রাজনৈতিক দলে যখন সংকটকাল যায় তখন এরা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় থাকে। মূলত এরা হাইজ্যাকার। ইতিপূর্বেও ১/১১’র দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।’

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘দল কখন বিক্ষোভ করবে, এটা তো দল ঠিক করবে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় এ ব্যাপারে। কখন কর্মসূচি দেয়া হবে, কখন হবে না, এটাও দল ঠিক করে। সেখানে আলাদা করে কয়েকজন মিলে বিক্ষোভের কোনো সুযোগ নেই। আর শোকজের প্রভাব দলে পড়বে না। দল আগের চেয়ে সংগঠিত আছে। তবে শোকজের পর তারা কী করবে, এটা দিন গেলেই স্পষ্ট হবে।’

কেএইচ/এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।