ঢাবি ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ
বিতর্ক-বিদ্রোহ যেন পিছু ছাড়ছে না জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। ২৭ বছর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করতে গিয়ে বড় বিদ্রোহের মুখে পড়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠনটি। সংগঠনটির কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ৯১ সদস্যের কমিটি ঘোষণার পর নতুন করে ছড়িয়েছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। ক্ষুব্ধ নেতাদের অভিযোগ, ঢাবি শাখার শীর্ষ দুই পদসহ প্রায় ৪৭টি পদ একটি সিন্ডিকেটের নেতারা বাগিয়ে নেয়ায় বাদ পড়েছেন অনেক কর্মীবান্ধব, ত্যাগী, পরিশ্রমী ও নির্যাতিত নেতা। অনেকের ক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। যদিও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে জায়গা পাবেন যোগ্য ও বঞ্চিতরা।
গত ডিসেম্বরে ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ৯১ সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক হয়েছেন রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সদস্য সচিব হয়েছেন আমান উল্লাহ আমান। বঞ্চিতদের অভিযোগ, এ দু’জনই সাবেক ছাত্রদল সভাপতি ও ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেট’ সদস্য সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর আশীর্বাদপুষ্ট। ছাত্রদলের যে কাউন্সিল হয়েছিল, সেখানে টুকু’র সিন্ডিকেটের সভাপতি প্রার্থী (পরে সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত) কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছেন দু’জন। নির্বাচনে শ্রাবণ পদে আসতে না পারায় ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার সিদ্দিকী’র পরামর্শক্রমে আমানউল্লাহ আমান যোগ দেন সংগঠনের নবনির্বাচিত সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের গ্রুপে।
পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতারা বলছেন, ঢাবি ছাত্রদলের কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে রাকিবুল হাসান রাকিব পদ পেয়েছেন কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের অনুসারী হিসেবে। আর সদস্য সচিব হিসেবে আমানউল্লাহ আমান পদ পেয়েছেন আবুল বাশার সিদ্দিকীর অনুসারী হিসেবে। শ্রাবণ ও বাশার উভয়েই সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারী।
সংগঠনের পদ-পদবি সিন্ডিকেট বাগিয়ে নেয়ার জের দেখা যায় সম্প্রতি ছাত্রদলের একাধিক কর্মসূচিতে। কিছুদিন আগে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার নতুন নেতৃত্ব ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে চার দিন কয়েক দফা এবং রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কয়েক দফা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনাগুলো বঞ্চিতদের ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ বলে ছড়ায় বিভিন্ন পরিসরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক বলেন, দিনের পর দিন পরিবারকে ফেলে, বাবা-মায়ের ভালোবাসা দূরে ঠেলে সংগঠনকে সময় দিয়েছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যে সংগঠনের জন্য মার খেলাম, জেল খাটলাম সে সংগঠন আমাদের বঞ্চিত করেছে। না পারছি বড় মুখ করে পরিবারের সামনে দাঁড়াতে, না পাচ্ছি সংগঠনের মূল্যায়ন। এভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক রাজনীতি চলতে থাকলে তরুণরা-মেধাবীরা রাজনীতিতে আসার আগ্রহ হারাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় এক দশক পর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আবারও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় ছাত্রদল। তবে সংগঠনটির কমিটি নিয়ে যে টানাপড়েন ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা ওই সক্রিয়তাকে স্থবির করে দেবে বলে আশঙ্কা বঞ্চিতদের।
সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মসূচিতে প্রথম সারিতে থাকা এবং ডাকসু ও হল সংসদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরাও রয়েছেন বাদ পড়া ও অবমূল্যায়িতদের তালিকায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মো. শাহিনুর ইসলাম শাহিন (ছাত্রদল মনোনীত সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থী, ডাকসু), সাইদুর রহমান রাফসান (ভিপি প্রার্থী, শহীদুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ), মোহাম্মদ ইমন (জিএস প্রার্থী, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্র সংসদ), জারিফ রহমান (এজিএস প্রার্থী, এ এফ রহমান হল ছাত্র সংসদ), নুরুল আমিন নূর (এজিএস প্রার্থী, শহীদুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ), জুবায়ের আহমেদ (এজিএস প্রার্থী, এস এম হল ছাত্র সংসদ), মো. মিনহাজুল হক নয়ন (সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থী, মুহসিন হল ছাত্র সংসদ), মেহেদী হাসান (সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থী, জহুরুল হক হল ছাত্র সংসদ)।
অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছেন ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে আলোচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার অনিকও। ডাকসুতে ছাত্রদলের ভিপি ও এজিএস প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক হলেও জিএস প্রার্থী অনিক হয়েছেন আহ্বায়ক কমিটির দুই নম্বর সদস্য। অথচ তার শিক্ষাবর্ষ থেকে যুগ্ম-আহ্বায়ক পদ মিলেছে নতুন কমিটিতে। একইভাবে অবমূল্যায়নের শিকার বুয়েট ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নির্যাতনের শিকার ঢাবির শহীদুল্লাহ হল শাখার সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াও। তিনি তার সেশনের নেতাদের পদবিরও নিচে স্থান পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম ফখরুল হাসানেরও স্থান হয়নি নতুন কমিটিতে।
হল শাখার সদস্য সচিবদের মধ্যে বাদ পড়েছেন- মনজুরুল আলম রিয়াদ (অমর একুশে হল), মোস্তাফিজুর রহমান রুবেল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল)। হল শাখার যুগ্ম-আহ্বায়কদের মধ্যে বাদ পড়েছেন- সাফি ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ শামিম আকতার শুভ, ইউনুস পিটু ও কামরুজ্জামান নাহিন (মাস্টারদা সূর্যসেন হল), নাদির শাহ পাটোয়ারী ও রিয়াদ রহমান (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), শিপন বিশ্বাস, কাউসার সরকার ও আফসার উদ্দিন (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল), মিঠুন কুমার দাশ (জগন্নাথ হল), নাজমুল মওদুদ হোসেন ও হাসান আল আরিফ (জসিমউদ্দীন হল), ফারহান আরিফ, নাকিব চৌধুরী, ছফী ওবায়েদুর রহমান সামিত, সালেহ মো. আদনান, বায়েজিদ হোসেন ও ইউসুফ হোসেন খান (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল), রাশেদ আল আমিন শুভ (অমর একুশে হল), দ্বীন ইসলাম, মুহসিন ভুইয়া, জিহাদুল ইসলাম রঞ্জু, জাহাঙ্গীর আলম ও সাইফুল ইসলাম শিমুল (মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল), মোহাব্বত আলী জয় (এ এফ রহমান হল), মাহফুজ আহমেদ ও মো. হাসান (মুহসিন হল)।
এর মধ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হামলার শিকার হন শিপন বিশ্বাস। সে সময় বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান চিকিৎসার দায়িত্ব নেন শিপনের। আর হল সংসদের নির্বাচনের দিন সূর্যসেন হলে ভোট দিতে গিয়ে হামলার শিকার হন মোহাম্মদ শামিম আকতার শুভ।
ছাত্রদলে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও যোগ্যদের পদ না দেয়া প্রসঙ্গে সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মুমিনুল ইসলাম জিসান জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গভীর রাতে শেখ হাসিনার মিড নাইট ইলেকশন স্টাইলে দেয়া হয়েছে। যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রদলের কমিটি হওয়ার কথা ছিল সেখানে রাত ২টা বাজে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এখানে ছাত্রদলের রাজপথের কর্মীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। নিয়মিত ছাত্রদের কমিটিতে না রেখে অছাত্রদের পদ দেয়া হয়েছে। এতে বিএনপির সামনের আন্দোলন ও সামনের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করলে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল জানান, বাদ পড়াদের মধ্যে যারা যোগ্য তাদের পরবর্তীতে কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তবে তা সময়সাপেক্ষ বলেও জানান তারা।
ফজলুর রহমান খোকন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে এখন আহ্বায়ক কমিটি আছে। এক মাসের মধ্যে সেগুলো পূর্ণাঙ্গ করার বিষয়ে ঢাবি শাখার নতুন নেতৃত্বকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপর সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। তখন ঢাবি ও কেন্দ্রীয় সংসদের কমিটিতে বাদ পড়াদের অনেকেই অন্তর্ভূক্ত হবেন।
তাছাড়া, ৬০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা হলেও এর আকার ১৭১ সদস্যের হতে পারে এবং এতেও অনেকের জায়গা হবে বলে জানান ছাত্রদল সভাপতি।
এইচএ/পিআর