ছাত্র সংগঠনগুলোর তহবিল সংগ্রহ হয় যেভাবে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজির অভিযোগে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে। এর ফলে ছাত্রলীগ ছাড়া বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আগে ও পরবর্তী সময়ে নানা সংকটের মুহূর্তে জনমুখী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার ইতিহাস রয়েছে এসব সংগঠনের। তবে সেই অতীত ইতিহাস ছাপিয়ে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়তে থাকে। যার সর্বশেষ চলতি মাসে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ।
প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত এসব সংগঠনগুলো আসলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করে এবং কীভাবে সংগ্রহ করে। এ বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় প্রতিটি দলের তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে দলের সদস্যদের নির্দিষ্ট হারে চাঁদা ধার্য এবং অনুদান থেকেই মূল অর্থায়ন আসে। তবে এছাড়াও আরও কিছু উৎস থেকে এসব ছাত্র সংগঠন তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটির নাম ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে দলীয় সদস্যদের চাঁদাকেই মূল ধরা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের জন্য বিভিন্ন হারে চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের প্রত্যেক সদস্য মাসিক ২০ টাকা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ১৫ টাকা, জেলা কমিটির সদস্যরা ১০ টাকা এবং নিম্নতম কমিটির সদস্যরা মাসিক ৫ টাকা হারে চাঁদা দেবেন।
তবে গঠনতন্ত্রে চাঁদা ছাড়াও এককালীন অনুদান, সদস্য ফি এবং ছাত্রলীগ কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তিকা বা বই বিক্রি করেও সংগঠনের তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। তহবিলে সংগ্রহের ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ওপরই নির্ভর করে সংগঠনটি।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার জানান, ছাত্রদলের লিখিত কোনো গঠনতন্ত্র নেই। খসড়া গঠনতন্ত্রে সদস্যদের চাঁদা দিতে হবে এ ধরনের কোন উল্লেখ নেই। গঠনতন্ত্রটি খসড়া হওয়ার কারণে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনা হয়।তবে তহবিলে সংগ্রহের ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, নেতাকর্মীদের চাঁদা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তবে দলের বা শুভাকাঙ্ক্ষী যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে সাহায্য করতে চান সেটা গ্রহণ করা হয় বা বিবেচনাধীন থাকে। লিখিত গঠনতন্ত্র না থাকায় সংগঠনটির একেকটি ইউনিট একেকভাবে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।
ছাত্রদলের একজন কর্মী মানসুরা আলম বলেন, তিনি কখনো চাঁদা দেননি। সদস্য হওয়ার সময় ১০০ টাকা করে ফি দিতে হয়, সেটা জানি। কিন্তু দলের তহবিলে আমি কখনো কোন চাঁদা দেইনি। কমিটির কাউকে চাঁদা দিতে হয় কি-না সেটাও জানি না।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ জানান, দুইভাবে সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গণ চাঁদা সংগ্রহ এবং রাস্তায় হকার বা ফুটপাতের দোকানদারদের কাছ থেকে গণ চাঁদা আদায় করা হয়।
তবে এটির হার কখনোই নির্ধারণ করে দেয়া হয় না। ৫ টাকা থেকে শুরু ১০০ টাকা পর্যন্ত বা যার যা ইচ্ছা সে হারেই চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত দলের কোনো বড় কর্মসূচি বা সম্মেলনকে সামনে রেখে এ ধরনের চাঁদা আদায় করা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী নিয়মিত চাঁদা দেন তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়। সংগঠনের সাবেক সদস্য যারা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। এছাড়া দলের কমিটিতে যে সদস্যরা থাকেন তাদের কাছ থেকেও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করা হয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী জানান, তিন উপায়ে তাদের দলের তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এগুলো হচ্ছে গণ চাঁদা, সাবেক চাঁদা এবং প্রকাশনা থেকে আয়।
তিনি বলেন, ছাত্র চাঁদা বা গণ চাঁদা যা মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। সাবেক সদস্যদের কাছ থেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা আদায় করা হয়। এর আওতায় রয়েছে শুভানুধ্যায়ী চাঁদা। সংগঠনটির প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত আয় দলীয় তহবিলে জমা হয়। এছাড়া ওই প্রকাশনায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের অর্থও যোগ হয় দলীয় তহবিলে।
বামপন্থী আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহ করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন কর্মকৌশলে উল্লেখিত অর্থব্যবস্থায় বলা হয়েছে, এ আন্দোলনের সর্বস্তরে বায়তুল মাল বা অর্থ তহবিল থাকবে। এর উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের এয়ানত ও এককালীন দান এবং প্রকাশনার মুনাফা হবে বায়তুল মালের উৎস।’
এছাড়া অধস্তন শাখাগুলো নিয়মিতভাবে বায়তুল মাল থেকে নির্ধারিত অংশ ঊর্ধ্বতন শাখায় দিতে বাধ্য থাকবে। দলটির নেতাকর্মীদের এককালীন দান তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেরাই নির্ধারণ করে থাকেন বলে জানা গেছে।
আরএস/জেআইএম