বন গবেষণা ইনস্টিটিউট : ছোট থেকে বড় কর্তা সবাই ব্যস্ত হরিলুটে


প্রকাশিত: ০৬:০৭ এএম, ২৫ আগস্ট ২০১৫

চট্টগ্রাম বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে সরকারি টাকায় চলছে লুটপাটের গবেষণা। ছোট থেকে বড় কর্তা সবাই ব্যস্ত সরকারি অর্থ হরিলুটে। চাকরি না করেও মাস শেষে বেতন তুলছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী! গত ৫৯ বছরে নেই কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা সাফল্য।

সম্প্রতি নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালেখি হওয়ার পর তা স্থগিত করেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে গরমিল, নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম, নিয়োগ কমিটির ছাড়পত্রের মেয়াদ না থাকা, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে মন্ত্রণালয়।

কিন্তু উক্ত নিয়োগ আদেশ নিতে মরিয়া হয়ে মন্ত্রণালয়ে দেন-দরবার আর দৌড়ঝাপ শুরু করেছে কথিত নিয়োগ কমিটির সদস্য রফিকুর ইসলামসহ অন্যান্যরা। এ ছাড়া পদোন্নতি নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।

ওয়ার্ক সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম পালন করছেন বিভাগীয় কর্মকর্তার (প্রশাসন) দায়িত্ব। এখন আবার উচ্চতর পদোন্নতি নিতে মন্ত্রণালয়ে দৌড় শুরু করেছেন তিনি। নিয়ম ভঙ্গ করে মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন বিভাগীয় কর্মকর্তা খুরশিদা আক্তার।

গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ভারপ্রাপ্ত হলেও মন্ত্রণালয়ের নিয়ম উপক্ষো করে তিনি এসব কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি দিয়েছেন। সূত্র জানায় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কোন কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেননা। এ ছাড়া অনেক পদস্থ কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জালের অভিযোগও রয়েছে।

কোটি টাকার দুর্নীতির দায়ে দুদকের মামলায় চার্জশিট দিলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। আবার গবেষণা কেন্দ্রের কর্মচারী অফিস সময়ে ডিউটি না করে ব্যস্ত থাকেন গবেষণা এলাকায় অবস্থিত নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রায়ই সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালেখি হলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়সারা ভাবের কারণে প্রতিবারই পার পেয়ে যায় এখানকার অনিয়মকারী আর দুর্নীতিবাজরা। উল্টো তারা সংবাদকর্মীদের ফাঁসানোর নানা কৌশল খুঁজতে থাকে।

আবার নিম্ন অধীনস্থ কর্মচারীদের অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ভয় পান উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সিবিএ’র কারণে উর্ধ্বতন কর্তারা মান সম্মানের ভয়ে ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকে এমনটাই বললেন বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম। অনিয়মকারী এসব নিম্ন অধীনস্ত কর্মচারীদের দ্বারা নাজেহাল হওয়ার ভয়ে দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন তারা।

দেশের একমাত্র বন গবেষণা ইনস্টিটিউটটি চট্টগ্রামের ষোলশহরে। সারা দেশের বন গবেষণার প্রধান কার্যালয় এটি। এখানে অতিরিক্ত সচিব পদ মর্যাদায় একজন পরিচালক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বন গবেষণা কেন্দ্রটি বনায়নের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে এখানে কর্মরত কর্মকর্তাদের পোয়াবারো হয়ে পকেট ভারী হচ্ছে এটা নিশ্চিন্তে বলা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৭৫০ জন লোকবলের এই প্রতিষ্ঠানটি এখনও রয়েছে লোক চক্ষুর আড়ালে। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা কিংবা বনায়নের উন্নয়নে কী ধরনের কাজ করে তাও সাধারণ মানুষের কাছে অজানা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি বরাদ্দ ভাগাভাগি করে রীতিমতনিজেদের আখের গোছাচ্ছে।


চলতি বছরে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই টাকার বেশির ভাগই কর্মকর্তারা রক্ষণাবেক্ষণ কাজ না করেই নিজেদের পকেটে পুরেছেন। আর এ নিয়ে গত ৯ জুন প্রতিষ্ঠানটির মাসিক সভায় কতিপয় কর্মকর্তার মধ্যে হাতাহাতি এমনকি জুতা মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।

এদিকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় দেশের একমাত্র পাইন বাগান ও বীজ উৎপাদন বাগানটিও প্রভাবশালীরা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগাজসে দখল করে সেখানে বসতিসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন।

গত মাসে গবেষণা খাতে এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেলেও নেই কোন গবেষণার ফলাফল। গত পাঁচ বা দশ বছরে কি গবেষণা করেছে বা নতুন কি উদ্ভিদ উদ্ভাবন করেছে তাও জানাতে পারেননি মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা খুরশিদা আক্তার। তাঁর অফিসে সরেজমিন গিয়ে গবেষণার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি একটি বহুদিন আগের পুরানো বাঁশের সোফা সেট দেখিয়ে বলেন এটিই নতুন গবেষণা। যা রীতিমত উপস্থিত অন্যান্য সংবাদকর্মীদেরকেও হতভাগ করে।

গবেষণা কেন্দ্রের পাহাড় কাটার মামলায় দুই কর্মচারী গ্রেফতার হওয়ার পরেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি রহস্য জনক কারণে। এ নিয়ে বিভাগীয় কর্মকর্তা প্রশাসন রফিকুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি অবগত নন।

এছাড়া গবেষণা কেন্দ্রের বিভিন্ন পদেও কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে বেতন উত্তোলনের অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আঁতাত করে এসব কর্মকর্তা কর্মচারীরা অফিস করেন না রীতিমত। মাসের কোন এক সময় অফিসে এসে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সঙ্গে বোঝাপড়া করে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যান। অভিযোগ উঠেছে- এরপর মাস শেষে বেতন উত্তোলনের সময় কথামতো উর্ধ্বতনদের দিয়ে দেন বেতনের একটি অংশ।

এসব অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ফরেস্ট রেঞ্জার দিলশাদ, ব্লাক স্মিথ (কামার) মো. আলী, মাঠ সহকারী পিযুষ কান্তি দাশ, নৌকা চালক অরুণ কুমার, ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি স্টেশনের সনাতন তরী।

অপরদিকে অফিস চলাকালীন সময়ে অফিস না করে গবেষণা কেন্দ্রের সম্মুখভাগে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে ব্যবসা করেন আরো কয়েকজন কর্মচারী। এরা হলেন, চা দোকানদার দক্ষকর্মী আমান উল্লা, মাঠ সহকারী মুদি দোকানদার আবদুর রহিম, ও এস নাছির মুদি দোকানদার, ও এস মুদি দোকানদার জসিম উদ্দিন।

এ ব্যাপারো বিভাগীয় কর্মকর্তা প্রশাসন মো. রফিকুল ইসলাম ও বিভাগীয় কর্মকর্তা (বীজ বাগান) হাসিনা মরিয়ম এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা জানান, এসব বিষয় তাদের জানা ছিলনা। খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান এ দুই কর্মকতা।

তবে বিভাগীয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, সিবিএ নেতা এবং কিছু উশৃঙ্খল কর্মচারী আর সিন্ডিকেটের কাছে মাঝে মধ্যে জিম্মি থাকেন তারা।

এছাড়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের জায়গায় কাঁচা ঘর নির্মাণ করে সেগুলো ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

অন্যদিকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা জহির কখনও নিজেকে বিজ্ঞানী আবার কখনো প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলে প্রচার করছেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরো ৪টি শাখা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অপরদিকে চট্টগ্রামে এই প্রতিষ্ঠানের আওতায় ২০টি স্টেশন থাকলেও এর ২টি অনেক আগেই বেহাত হয়ে গেছে।

এর একটি ফটিকছড়িতে, অপরটি কক্সবাজারের উখিয়ায়। উখিয়ারটির কার্যক্রম কয়েক বছর আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে রহস্যজনক কারণে, আর ফটিকছড়ির স্টেশনটি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বেহাত হয়ে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। যে ১৮টি স্টেশন রয়েছে সেগুলোও নামকাওয়াস্তে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় রাঙ্গুনিয়ায় একটি পাইন বাগান ও বীজ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু ওই পাইন বাগানের বর্তমান কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের যোগসাজসে এবং এর আগের কর্মকর্তার কারণে বাগানের ভেতরের অনেক জায়গা প্রভাবশালী ও স্থানীয়রা দখল করে নিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে পাইন বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাকা দিয়ে সেখানে বসতি ও দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে গাছ কেটে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ বসতি।

পাইন বাগান দখলের বিষয়ে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শাহীন আকতারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। নিয়োগ বাণিজ্য আর কর্মচারীদের অফিস না করার বিষয়ে তিনি বলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

এসএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।