কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল : ৫৪ টি পদের মধ্যে ২৬ টিই শূন্য


প্রকাশিত: ০৩:২৬ এএম, ২৯ জুলাই ২০১৫

কুষ্টিয়ার ২২ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল। এ হাসপাতালের ৫৪ জন চিকিৎসকের মধ্যে ২৬ টি পদ শূন্য থাকায় কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী থেকে নৌকা শ্রমিক আসগার আলীর স্ত্রী জরায়ুর ক্ষত অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে। আসগার জানালেন, এক মাসের বেশি সময় অপারেশনের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে এক দালালের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শে শহরের একটি ক্লিনিকে গিয়ে ভর্তি হয়ে দুইদিনের মাথায় চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। মাঝে থেকে ক্লিনিকের বিল মেটাতে তার একমাত্র মাথা গোজার ঠাঁয় টিনের ঘরটি বিক্রির টাকা এনে দিতে হয়েছে।

সদর উপজেলার উজানগ্রামের কৃষক আলাউদ্দিনের স্ত্রী রোমেলা খাতুন প্রসব বেদনায় ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। জরুরি সিজারের প্রয়োজন হলেও হাসপাতালে সম্ভব হয়নি। গাইনি ওয়ার্ডের নার্সের পরামর্শে জরুরি ভিত্তিতে শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে ৮ হাজার টাকার চুক্তিতে সিজার করতে হয়েছে বলে জানালেন আলাউদ্দিন।

ভেড়ামারা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের আয়শা খাতুন তার সাড়ে ৩ মাসের বাচ্চাকে শ্বাসসকষ্টজনিত সমস্যায় ডাক্তার দেখাতে বর্হিবিভাগের টিকিট নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টা। টিকিট নিয়ে শিশু বিভাগের ডাক্তারের কক্ষে সিরিয়াল দিয়ে দুপুর দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা শেষে ডাক্তার বেরিয়ে চলে যায়। অবশেষে চিকিৎসা না পেয়ে এক দাললের মোবাইল ব্যবহার করে বাড়িতে ফোন করে কর্জকৃত টাকা এনে শহরের কলেজ মোড়স্থ একটি ক্লিনিকে হাসপাতালের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসা ওই একই চিকিৎসকের কাছে বাচ্চাটাকে দেখিয়ে চিকিৎসা পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে যান বলে অভিযোগ করলেন আয়শা খাতুন।

কুমারখালী উপজেলার বানিয়াপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক আজিজুল (৩৮) মূত্রপ্রণালীর জটিলতায় ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালের ২নং পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে। সেখানে ভর্তির পর ৭দিন ধরে চিকিৎসা চলাকালীন থেকে ছাড়পত্র পাওয়া পর্যন্ত সকল ঔষধ বাইরের দোকান থেকে ক্রয় করতে তার জীবিকার একমাত্র বাহন ভ্যান গাড়িটি বিক্রি করতে হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন তিনি।

সদর উপজেলার বোয়ালদাহ গ্রামের বিধবা নাসিমার অভিযোগ, তার ৯বছর বয়সী ছেলে স্বপনকে টনসিলাইটিস জটিলতায় বর্হিবিভাগের টিকিট নিয়ে ইএনটি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক নানা বিষয় উল্লেখ করে রোগীর প্রানহানির আশঙ্কার ভয় দেখিয়ে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা জোগাড় করে দ্রুত ওই চিকিৎসকের পছন্দের ক্লিনিকের নাম বলে সেখানে পাঠিয়ে দেন। নাসিমা ক্লিনিকে গিয়ে টাকার পরিমাণ এবং তা সাধ্যের বাইরে জেনে বাড়ি ফিরে গিয়ে এলাকার বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে ছেলে স্বপনের চিকিৎসার জন্যে।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে আব্দুল হাই (৫২) জানান, তিনি এসছিলেন হৃদরোগজনিত সমস্যায় চিকিৎসা নিতে। শুনেছেন কুষ্টিয়াতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হওয়ায় বড় বড় ডাক্তার আছে। জরুরি বিভাগে হাজির হলে তাকে বর্হিবিভাগের টিকিট নিয়ে ৭নং কক্ষে দেখানোর কথা বলেন। সেখানে লম্বা সিরিয়াল শেষে ডাক্তারের দেখা পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু একজন অল্প বয়সী ছেলে এক মিনিটেই বর্হিবিভাগের ওই টিকিটে কয়েকটি ঔষধ লিখে দিয়ে সেগুলি ঠিকমত খেতে বলেন।

জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন বলেন, জেলার ছয়টি উপজেলার ২২লাখ জনগণের জরুরি ও উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সংকট থাকায় প্রায়ই সেখানে রোগীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।

জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার এই অবস্থার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এখানে বলতে গেলে প্রায় সবগুলো বিভাগেই পদ শুন্যতায় চিকিৎসক সংকট রয়েছে। ফলে সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

সিভিল সার্জন ডা. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, জেলার ছয়টি উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অপেক্ষাকৃত নবীন চিকিৎসকদের দিয়ে কোনোভাবে কাজ চালাতে পারলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য জেনারেল হাসপাতালে আগত রুগীদের চিকিৎসক সংকটের কারণে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানোর অভিযোগও আসে কিছু কিছু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আজিজুন নাহার জানান, এখানে ধারণ ক্ষমতার বাইরে সবসময়ই দ্বিগুণ কখনোবা তারও বেশি ভর্তিকৃত রোগীর ঝুঁকি সামলাতে হয়। প্রতিদিন বর্হিবিভাগে সমগ্র জেলা থেকে আগত প্রায় ১৫শত রোগীর সেবা দিতে অন্তত ১৫ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন থাকলেও তা সামলাতে হচ্ছে ৫ জন চিকিৎসককে দিয়ে।

তিনি আরো বলেন, জরুরি বিভাগের ৪ টি পদ থাকলেও পদ শূন্যতায় মাত্র একজন চিকিৎসককে দিয়ে কাজ চালাতে হয়। সার্জিক্যাল বিভাগে কনসালটেন্ট চিকিৎসকের ৩ টি পদের মধ্যে একজনকে দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে। এভাবে প্রায় সকল বিভাগসহ ৫৪ জন চিকিৎসক পদের মধ্যে ২৬টি পদই শূন্য রয়েছে প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় ধরে।

এছাড়া বর্ধিত রোগীর চাপ মোকাবিলায় ঔষধ সংকটের অভিযোগ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এই পরিস্থিতির উত্তোরণে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন স্বাস্থ্য দফতর ও কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবগত করা হয়েছে। এমনকি বিষয়টি হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও মাননীয় তথ্যমন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু মহোদয় অবগত আছেন।  

হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক জানান, বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। এর উত্তোরণে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরে একাধিকবার তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখনো তার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

আল-মামুন সাগর/এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।