হিজড়া শনাক্তকরণে ডাক্তারি সনদ বাধ্যতামূলক হচ্ছে


প্রকাশিত: ০২:১৭ পিএম, ৩০ জুন ২০১৫

হিজড়া শনাক্তকরণে ডাক্তারি পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রাথমিক জরিপ অনুসারে দেশে হিজড়ার সংখ্যা আনুমানিক সংখ্যা ১০ হাজার। দু`দিন আগে ডাক্তারি (লিঙ্গ নির্ধারণ) পরীক্ষায় কথিত ১২ হিজড়া পুরুষ হিসেবে শনাক্ত হওয়ার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর দেশে হিজড়ার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মনে ব্যাপক সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের চলমান হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এই ১২ জন ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিজড়া পরিচয়ে অধিদফতরে চাকরির জন্য আবেদন করে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু লিঙ্গ নির্ধারণী পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে তাদের প্রকৃত পরিচয়।

সমাজসেবা অধিদফতরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কথিত ১২ হিজড়ার পুরুষ শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। তারা ভাবতেও পারেননি পুরুষ হয়েও এরা হিজড়া পরিচয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অপচেষ্টা চালাতে পারে।

জানা গেছে, হিজড়াদের নিয়ে তারা নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, খুব শিগগিরই  মন্ত্রী, সচিব ও সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সভা ডাকতে যাচ্ছেন।

সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক পারভীন মেহতাব মঙ্গলবার জাগো নিউজকে বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ছাড়া প্রকৃত হিজড়া শনাক্ত করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। এতদিন তারা হিজড়াদের বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সনদের ওপর নির্ভর করলেও এখন তারা ভিন্ন চিন্তাভাবনা করছেন।

তিনি জানান, খুব শিগগিরই হয়তো লিঙ্গ নির্ধারণী পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হতে পারে। রাজধানীসহ সারাদেশের মেডিকেল কলেজ ও জেলা, উপজেলা হাসপাতালে হিজড়াদের লিঙ্গ নির্ধারণী পরীক্ষার জন্য ডাকা হতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মন্ত্রী, সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্মতিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এ কথা সত্যি যে ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়া লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব নয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় বাহ্যিকভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও গড়ন দেখে প্রাথমিকভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

এছাড়া এক্সরে অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ ও নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে সম্পুর্ণ পেটের (হোল অ্যাবডোমেন) আলট্রাসনোগ্রাম ও এক্সটারনাল জেনিটাল অরগান পরীক্ষার মাধ্যমেও শনাক্ত করা যায়।

তিনি জানান, লিঙ্গ নির্ধারণে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত তথ্য কেরোটাইপিং পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া যায়। এ পরীক্ষায় জনপ্রতি তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়।

তিনি আরো জানান, সম্প্রতি সমাজসেবা অধিদফতর থেকে ১২ জন কথিত হিজড়াকে লিঙ্গ নির্ধারণী পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। ফরেনসিক, গাইনি, অ্যানাটমি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তাদের প্রত্যেকের  শারীরিক ও মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করেন।

তাদের শরীরে আর ১০টা পুরুষের মতো লিঙ্গ, অন্ডকোষ ও  শুক্রতলী পাওয়া যায়। গঠিত কমিটি তারা প্রকৃতপক্ষে পুরুষ হিসেবে শনাক্ত করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ (না পুরুষ না নারী) হিসেবে ঘোষণা করে।

অভিযোগ রয়েছে, সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণার পর দেশে একটি সংঘবদ্ধ চক্র মেয়েলি স্বভাবের পুরুষদের হিজড়া সাজিয়ে জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ ধরনের মেশিনের সাহায্যে তারা ত্বক, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের লোম তুলে রূপসজ্জা করে মেয়ে সেজে থাকে। তারা লঞ্চ, বাস, রেল স্টেশন, বিপণী বিতান, বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও রাস্তাঘাটে মানুষকে জিম্মি করে টাকা পয়সা উপার্জন করে।

কথিত ওই সব হিজড়াদের গুরু হিজড়াদের প্রায় প্রত্যেকের সংসার ও ছেলে মেয়ে রয়েছে। তাদের কারণে প্রকৃত হিজড়ারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।

সমাজে বৈষ্যম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে সমাজসেবা অধিদফতর। অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃত হিজড়াদের পারিবারিক, আর্থ সামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের সাত জেলায় শুরু হয়।

ওই বছর ৭২ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ২০১৩-২০১৪ সালে চার কোটি ও ২০১৪-২০১৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে চার কোটিতে দাঁড়ায়। মোট ২১ জেলায় এ কার্যক্রম চলছে।

জানা গেছে, স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে (জনপ্রতি মাসিক ৩০০ টাকা, মাধ্যমিক ৪৫০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক ৬০০ টাকা ও উচ্চতর শিক্ষা কোর্সে ১০০০ টাকা করে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অস্বচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা হিসেবে মাসিক জনপ্রতি ৪০০ টাকা প্রদান করা হচ্ছে।

বিগত তিন বছরে দেড় সহস্রাধিক হিজড়াকে শিক্ষা উপবৃত্তি, ২ হাজার ৩শ জনকে ভাতা ও ২ সহস্রাধিককে প্রশিক্ষণ ও ৫ শতাধিককে প্রশিক্ষণোত্তর সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তারা জানান।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন বলেন, হিজড়াদের সম্পর্কে আমাদের সমাজে যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমাজের মূলস্রোতধারায় তাদের সম্পৃক্ত করতে মানসিক কাউন্সিল ও শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তবে ভুয়া হিজড়াদের কারণে প্রকৃত হিজড়ারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এমইউ/বিএ/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।