গো-খাদ্যের অভাবে গরু বিক্রি করছে কক্সবাজারের বন্যাকবলিতরা


প্রকাশিত: ১১:০৭ এএম, ৩০ জুন ২০১৫

সপ্তাহব্যাপী টানা বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে কক্সবাজার জেলার দশ লক্ষাধিক মানুষ।  বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে আবাসস্থল।  পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সরকারি আশ্রায়ণ কেন্দ্র কিংবা বেড়িবাঁধ কিংবা উচু স্থানে।  তাদের সাথে স্থান নিয়েছে বাড়ির পোষা প্রাণিগুলোও।  পানিবন্দির কারণে উনুনে হাড়ি তোলা সম্ভব হয়নি এসব মানুষের।  বাড়ি-ঘর জলমগ্ন হয়ে থাকায় অনেক পরিবার হারিয়েছে ধান, চাউলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রি।  মানবিক এ বিপর্যয়ে মানুষের সহায়তায় প্রশাসন, রাজনীতিক ও বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে এসে কিছুটা খাদ্য সহায়তা দিয়ে দূর্গতদের প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গো-খাদ্য ‘খড়’ ভেসে যাওয়ায় গৃহপালিত প্রাণির প্রাণ স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে তাদের মালিকরা।  পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করায় মাঠ-ঘাট ডুবে গিয়ে চরম সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যে।  খড়, কুড়া, ভূষী ও ঘাস না পাওয়ায় বেড়িবাঁধ, উচু স্থান ও সড়কগুলোতে মানুষের পাশাপাশি আশ্রয় নেয়া এসব প্রাণিগুলোর চলছে শোচনীয় দশা।  আবার যেসব দোকানপাট বন্যা থেকে রক্ষা করা গেছে সেসব দোকানে গো-খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী দাম হওয়ায় কিনেও খাওয়াতে পারছে না দুর্গতরা।

সূত্র মতে, কক্সবাজার জেলার আট উপজেলার প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত হয়েছে।  বৃষ্টি বন্ধ হলেও এখনো পানির নিচে রয়েছে অনেক এলাকা।  এসব এলাকার ১০ লক্ষাধিক মানুষের পাশাপাশি পানিবন্দি হয় লক্ষাধিক পৃহপালিত প্রাণি।  খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্য নিয়ে ত্রিমুখী সংকটের সময় পার করছে বন্যার কবলে পড়া মানুষগুলো।  বানের পর কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হলেও কোনো কোনো এলাকায় এখনো পৌঁছেনি ত্রাণসামগ্রী।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের খরুলিয়া, বাংলাবাজার গ্রাম ও রামু বাঁকখালী নদী সংলগ্ন বেঁড়িবাধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যা উপদ্রুত রামুর গ্রামগুলোতে অনেক গোয়াল-ঘর ভেঙে গেছে।  অনেক পরিবার বাঁশের মাচা বানিয়ে পশুগুলোকে নিরাপদ স্থানে রাখার চেষ্টা করছে।  আবার অনেকে নিজেদের সাথে সড়কের উপর কিংবা আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে রাখেন জীবন জীবিকার সহায়ক গবাদী পশুগুলো।  কিন্তু আশ্রয়টা নিরাপদ করা গেলেও তাদের খাবার নিয়ে এসব স্থানেই বিপাকে পড়েছেন গৃহমালিকরা।

রামুর ফতেখারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, বন্যায় উপজেলার সিংহভাগ এলাকা পানির নিচে ডুবে থাকায় ঘাস মরে পঁচে গেছে।  এতে গবাদিপশু নিয়ে অনেকে বিপাকে পড়লেও সহায়তার কোনো উপায় কেউ বের করতে পারেনি।

বাসা-বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাবার পর থেকে পূর্ব খুরুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় আবদুল হক।  সাথে নিয়ে এসেছেন তিনটি গরু ও দুটি ছাগল।  পশুগুলো খাবারের জন্য ছটপট করছে।  কিন্তু কিচ্ছু করার নেই আনোয়ারের।  তিনি বলেন, নিজেরাই পেট ভরে খেতে পাচ্ছি না, গরু-ছাগলকে কোথা থেকে খাবার দিব?

একই কথা জানালেন চকরিয়া বদরখালী এলাকার আলী আজগর, সদর উপজেলার মধ্য পেকাখালী নুরুল আবছার, পশ্চিম পোকখালী হাফেজ নুরুল আমিন, চৌফলদন্ডীর খামারপাড়ার শাহজাহান, খোনকারখীল এলাকার হারুন-অর-রশিদ, জালালাবাদের ফরাজীপাড়ার মাওলানা হাবিব উল্লাহসহ অনেক বন্যা দূর্গত।

তাদের মতে, গো খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।  একদিকে গরুর আবাস নিয়ে যেমন বিপাকে পড়তে হয়েছে। তেমনি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে খাবার নিয়ে।  কিভাবে এসব প্রাণির জীবন চালনা স্বাভাবিক রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তিত তারা।

চকরিয়ার বেতুয়াবাজার গ্রামের কৃষক ফজল করিম বলেন, গরু নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উচ্চদামে খাদ্য কেনা সম্ভব হচ্ছে না।  গরুর চারন-ভূমি ডুবে যাওয়ায় কোথাও চরাতেও নিতে পারছি না।  গত শনিবার সস্তায় ১টি গরু বিক্রি করে অন্যান্য গরুর খাবারের ব্যবস্থা করেছি।

উপজেলার কোনাখালী এলাকার আমিনুল হক ৭টি গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতেন।  কিন্তু গরুগুলোকে গত ৪দিন ধরে ঠিকমতো খাবার দিতে পারেননি তিনি।  আগামী কয়েক দিনে গো-খাদ্য সঠিকভাবে পাওয়া যাবে তা ঠিক করে উঠতে না পেরে স্বাদের পোষা গরু থেকে কয়েকটি বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছেন।

তারমতো রামপুর এলাকার খামারি ইছহাকও একই বেকায়দায় পড়ে গরু বিক্রির উদ্যোগী হচ্ছেন বলে জানাগেছে।

কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অজিত কুমার সরকার বলেন, বন্যার কারণে চারন ভূমির ঘাস সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হওয়ায় জেলার গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।  বন্যা কবলিতরা স্বল্প আয়ের হলেও যেকোনো ভাবেই নিজেদের খাদ্যাভাব মেটাতে পারে কিন্তু গবাদিপশুর খাদ্যের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

কক্সবাজার জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ড. অনুপম সাহা জানিয়েছেন, জেলায় বন্যাদুর্গত এলাকায় ১৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৭০ হাজার জনকে আশ্রয় দেয়া হয়।  খোলা হয়েছে আট উপজেলায় ৮টি কন্ট্রোল রুম।  এছাড়াও দুর্গত লোকদের জন্য ১৪৫ মে.টন চাল, নগদ ১১ লাখ টাকা, ৫০ বস্তা চিড়া বরাদ্ধ দেয়া হয়।  বন্যায় দুর্যোগের কবলে পড়ে মারা যাওয়া লোকজনের পরিবারে ২০ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে, সঠিক সংখ্যা বলতে না পারলেও বানে মানুষের মতো অসংখ্য প্রাণী দুর্ভোগে পড়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসাক।

এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।