নড়াইলে স্কুলগুলোতে কম্পিউটার শিক্ষার বেহাল দশা
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও নড়াইলে মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষার বেহাল দশা। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষার বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অর্ন্তভূক্ত থাকলেও নড়াইলে বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হাতে-কলমে কম্পিউটার শেখানোর কোন উদ্যোগ নেই।
জেলার তিনটি উপজেলার ৯২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১৯টি মাদ্রাসায় সরকারিভাবে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর এবং কম্পিউটার দেওয়া হলেও হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কিন্তু কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর পরিচালনার জন্য দক্ষ শিক্ষকের অভাবের সংখ্যাও কম নয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিজেই কম্পিউটার চালাতে পারদর্শী নন। এ কারণে কম্পিউটার শিক্ষার মান শূন্যের কোটায় পড়ে আছে।
জেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১২৭ টি ও দাখিল মাদ্রাসা ৩৪টি। এই ১৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাগজে-কলমে কম্পিউটার থাকলেও বাস্তবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কম্পিউটার নষ্ট কিংবা অন্যের কাছ থেকে ধার করে আনা কম্পিউটার দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। আবার সরকারিভাবে যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে অনেকে সেগুলো চালাতে পারেন না।
মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা আরো করুণ। তিন উপজেলার মধ্যে ১৫টিতে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর এবং কম্পিউটার নেই। তবে কাগজে-কলমে যেসব মাদ্রাসায় এগুলো দেওয়া হয়েছে বাস্তবে তার দুই তৃতীয়াংশ মাদ্রাসায় লোডশেডিংয়ের অজুহাতে শিক্ষা দেওয়া হয় না। জেলার ৫৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে কম্পিউটর শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অর্ন্তভূক্ত করা হয়। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নের কথা বলে মোটা অংকের অনুদান নিয়ে এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে ব্যয় করা হয়নি। নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ শিক্ষকের কম্পিউটর প্রশিক্ষণের সনদ মানসম্মত নয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটর আছে সেগুলোর শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেন না।
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে জানান, দুই বছর আগে এসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার, ল্যাবটপ, প্রজেক্টর সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন পাঁচটি করে ক্লাস নেওয়ার কথা। কম্পিউটার শিক্ষকদের যশোর এবং খুলনা টিচার্চ ট্রেনিং কলেজ থেকে এ বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না ঈদের পর অভিযান চালানো হবে।
তিনি আরো বলেন, এসব সমস্যা উত্তোরণ করতে হলে প্রধান শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদকে আন্তরিক হতে হবে। সংশিষ্ট শিক্ষককে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে।
কালিয়া উপজেলার নিউ মডেল একাডেমি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঘোর মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫০ জন কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তবে কম্পিউটার বিভাগে একজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া আছে। বর্তমানে ওই শিক্ষককে দিয়ে অন্য ক্লাস করানো হচ্ছে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাগো নিউজকে জানায়, শিক্ষক থাকলেও আমাদের কম্পিউটার শেখানো হয় না। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও আমরা কম্পিউটার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। কম্পিউটর শিক্ষক শ্রীবাস বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন,বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাবো কী?
সদর উপজেলার গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১২ জন ও ছাত্রছাত্রী ২৫০ জন। বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও কম্পিউটার থাকলেও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। অথচ ২০১২ সালে কম্পিউটর বিভাগে তাপস পাঠককে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এখানে এমপিওভূক্ত শিক্ষক।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ মন্ডল জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যালয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রজেক্টর সব কিছুই আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এখনো ছাত্র-ছাত্রীদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।
খড়ড়িয়া এজিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার, প্রজেক্টর ও বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। অথচ কম্পিউটারের শিক্ষক বিপ্লব হাজরা এমপিওভুক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার শিক্ষা না দিয়ে বেতন-ভাতা তুলছেন নিয়মিত।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পশুপতি মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, কম্পিউটার শিক্ষককে দিয়ে অন্য ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। রতন বিশ্বাস নামে একজন শিক্ষক মাঝেমধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটর শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। এমন অবস্থা গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
এদিকে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল পৌর মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনে প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করেছে। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে রয়েছে ১৭টি ল্যাপটপ, ১টি লেজার প্রিন্টার, ১টি স্ক্যানার, ১টি এলইডি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ১টি থ্রি-জি পকেট রাউটারসহ যাবতীয় সরঞ্জাম। কিন্তু যে শিক্ষকের নিরলস প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানটি সম্মানে ভূষিত হয়েছে সেই শিক্ষকের বেতন-ভাতা সরকারি কোটায় পান না। বিদ্যালয়ের এমপিও কোড নাম্বার ভুলের কারণে এমনটি হয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলার ২৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ১১টি মাদ্রাসায় ল্যাপটপ, প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষক আছেন। তবে কম্পিউটার পরিচালনার ক্ষেত্রে তেমন পরদর্শী নন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর প্রভাবটা বেশি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কিশোরী মোহন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার শিক্ষক এখনোও তেমন দক্ষ হয়ে ওঠেননি। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি নেটের সমস্যাও রয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও নেই। ঈদের পরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এসএস/এমএস