ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় হট্টগোল

বুধবার সকাল ১০টা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের সঞ্চালনায় শুরু হয় সাধারণ সভা। নির্ধারিত চারটি এজেন্ডা নিয়ে শুরু হওয়া এ সাধারণ সভায় কয়েক দফায় হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক কেন্দ্রীয় নেতার তীব্র সমলোচনার মুখে পড়তে হয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনকে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলে এ সভা।

বর্তমান কমিটির নির্ধারিত সময় শেষ হচ্ছে চলতি মাসের ২৫ তারিখ। কিন্তু এখনও কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা না করায় প্রতিবাদ করেন অনেক নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন শেখ রাসেল টাওয়ার থেকে টেন্ডারবাজির অভিযোগ ওঠে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। সমালোচনা হয়েছে তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়েও। এছাড়া নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি দিতে বিলম্ব হচ্ছে বলেও অভিযোগ অনেকের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিনিয়র নেতারা সংগঠন পরিচালনায় বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন।

সভায় উপস্থিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে যে বিষয়টি নিয়ে সভায় সবচেয়ে বেশি হট্টগোল সৃষ্টি হয় সে বিষয়টি হচ্ছে সভা চলার একপর্যায়ে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলি না। বিবাহিতদের কমিটিতে রাখা যাবে না, সেটাও মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বলে দিতে হয়। যেহেতু গঠনতন্ত্র আছে, তা সম্পূর্ণভাবে ফলো করতে হবে। আর ফলো করা না হলে বলতে হবে, গঠনতন্ত্র অবৈধ। কারণ ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই যখন কাউন্সিল হয় তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হিসেবে আমি দুই বছর রাজনীতি করার স্বপ্ন দেখেছি। দুই বছরকে ধরেই আমি সবকিছু সাজিয়েছি। আগামী ২৬ তারিখের (জুলাই) পর কমিটি যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকে, তাহলে আমাদের কোনো রূপরেখা থাকবে না। আমাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া হোক।’

তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, যদি আগামী ২৬ তারিখের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য কমিটি থেকে যায়, তাহলে কি এতদিনের জন্য আমি আমার বিয়ে আটকে রাখব? পারিবারিক জীবন থেমে থাকবে। কথা হলো, ২৬ তারিখের পর কমিটি থাকবে কি থাকবে না- এই প্রশ্নের উত্তর আমরা বিভিন্ন জায়গায় পেয়েছি। সেই উত্তরটা হলো- জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন বলবেন, তখন কমিটি হবে। হ্যাঁ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কখন বলবেন তাও আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির জানা দরকার। আমরা আপার কাছে গিয়ে বলি যে, আপা ২৬ তারিখ আমাদের মেয়াদ শেষ। আপনি আমাদের নেত্রী। আপনি যদি মনে করেন আপনার প্রয়োজনে এই ছাত্রলীগ আগামী নির্বাচন করবে তাহলে আমরা নির্বাচন করব। আর আপনি যদি মনে করেন, এই ছাত্রলীগের চাইতে আরও পরিশীলিত ছাত্রলীগ, শক্তিশালী ছাত্রলীগ দিয়ে আগামী কমিটি হতে পারে। তাহলে তাই হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান যে আমার থেকে আরও জ্ঞানী হবে না, তার গ্যারান্টি কি? যারা বলে, নতুন কমিটি হলে নতুন যারা আসবে তারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা এটা মানি না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জননেত্রী শেখ হাসিনার সংগঠন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থাকলে, জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকলে এই ছাত্রলীগ থাকবে। তাই ২৬ তারিখের পরে আমাদের রূপরেখা কী হবে পরিকল্পনা কী হবে- তা নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচনের প্রশ্ন আসছে কেন? ছাত্রলীগ কি নির্বাচনমুখী সংগঠন? আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী সংগঠন। ছাত্রলীগ ছাত্রদের সংগঠন। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে আদর্শিক জায়গা থেকে ছাত্রলীগ সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এখানে আমি দায়িত্বে না থাকলেও তো সাহায্য হবে। আমি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক না থাকলে অন্য একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলে সে সাহায্য করবে। ছাত্রলীগ তো নির্বাচনমুখী সংগঠন না। তাহলে নির্বাচনের প্রশ্ন বারবার কেন? আর যদি আগামী নির্বাচন এই ছাত্রলীগ করে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। যেহেতু জননেত্রী শেখ হাসিনার কথা আসছে- তাহলে সেটা তার সামনেই স্পষ্ট হবে। তিনি যেই বার্তা দিয়েছেন তা সংবাদ সম্মেলন করে জানাতে হবে। যদি জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের দেখা করার সুযোগ না থাকে, তাহলে আমরা খোলা চিঠি লিখতে পারি। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শুধু শুধু ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা যাবে না।’

সায়েম বলেন, ‘দুই বছর ছাত্রলীগের মেয়াদ মেনে নিয়েছি। দুই বছর পরে ছাত্রলীগের নামে টাকা ওঠে। অর্থ বিত্ত যা আসে ছাত্রলীগের নামে আসে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি যারা হয়, তাদের কাছে ছাত্রলীগের নেতাদের ভাগ্যের আমানত থাকে। সেই আমানতের খেয়ানত ২৬ তারিখের পরে হতে দেব না। ছাত্রলীগের যত টাকা আসে ছাত্রলীগের নামে, তার ভাগ করতে হবে। আমরা তো বাসায় গিয়ে থাকতে পারি না। কাল আমার এক কলিগ বলেছে, সেও বাসায় গিয়ে থাকতে চায়, কিন্তু পারে না। এখানে ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি যারা হয়, তাদের কেউ আগে এমন কোনো মহীয়ান লোক ছিল না যে তাদের মানুষ এমনিতে টাকা দিয়ে দেবে। মানুষ ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারিকে দেয়। সংগঠন পরিচালনার জন্য দেয়। সংগঠনের পেছনে ব্যয় করতে হবে। সংগঠনের পেছনে যদি ব্যয় না হয়, আমি কেন্দ্রীয় নেতা, আমি মনে করি ঠিকভাবে আমি সম্মানিত হচ্ছি না। ছাত্রলীগে আমার যথাযথ সম্মান পাচ্ছি না। তাহলে কেন আমি সেটা মেনে নেব?’

এ সময় সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘টাকার উৎস কিন্তু বলেন নাই।’ এ সময় সায়েম খান বলেন, ‘ঈদ পারপাস একটা টাকা আসতে পারে, যার একটা ভাগ-বাটোয়ারা আমরা পেয়েছি।’ তখন সোহাগ বলেন, ‘কে দিসে? তখন সায়েম খান বলেন, ‘এটা আসে। ঈদের টাকা আমরা পেয়েছি। টাকার উৎস-বিভিন্ন ভবন, বিভিন্ন জায়গা থেকে।’ তখন সোহাগ বলেন, ‘সবগুলো ভবনের টাকা আপনাকে আজকে নিশ্চিত করতে হবে।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘সবগুলো ভবন তো বলি নাই।’ সোহাগ বলেন, ‘আমরা তো এক টাকাও পাই নাই।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘পান নাই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন থেকে কোনো টাকা পান নাই? তখন সোহাগ আবারও বলেন, ‘এক টাকাও পাই নাই।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘তাহলে আপনি বাসা ভাড়া দেন কীভাবে? ৫৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন কীভাবে? আপনি বলেন, বাসা ভাড়া দেন কীভাবে? তখন সোহাগ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টাকা দেন। তখন সায়েম খান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টাকা দিলে সেই টাকার ভাগ তো আমারও আছে। তাহলে আমার ভাগও দিতে হবে। আমি তো বাসায় থাকতে পারি না।’

তখন সোহাগ পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সংগঠন কীভাবে চলে? তখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ হয়ে অনেকেই বলেন, ‘টাকার হিসাব দেন।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ারের ভাগ বাটোয়ারা হইছে না? তখন সোহাগ বলেন, ‘কোন রাসেল টাওয়ার? সায়েম খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ার। তখন সোহাগ বলেন, ‘আমি তো ভাগ পাই নাই।’ সায়েম খান বলেন, ‘আমি তো শুনছি।’

এ সময় সাধারণ সম্পাদক জাকির বলেন, ‘আপনি প্রমাণ দেন।’ জবাবে সায়েম খান বলেন, ‘আপনারা যদি ভাগ না পান তাহলে আমি কালকে গিয়ে ধরি, দেখবেন প্রমাণ বের হয়ে যাবে।’ এ সময় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ নিয়ে তুলনামূলক জুনিয়র নেতারা সভাস্থলে হট্টগোল তৈরি করেন। সোহাগ বলেন, ‘আপনি যা তা বলতে পারেন না।’ সায়েম খান জবাবে বলেন, ‘যা তা বলি নাই। আমাকে জবাব দেন বাসা ভাড়া দেন কীভাবে?’ জাকির বলেন, ‘আপনি আমাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস জানেন?’ সায়েম খান বলেন, ‘আপনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে তো হলেই থাকতেন।’ উত্তরে জাকির বলেন, ‘যা তা বলবেন না।’ সায়েম খান বলেন, ‘যা তা বলি নাই।’ এ সময় জাকির বলেন, ‘শুধু জনপ্রিয়তার জন্য কথা বললেই হয় না।’ সায়েম খান বলেন, ‘আমি জনপ্রিয়তার জন্য কিছু বলি নাই।’ তখন সোহাগ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আমার বাসা ভাড়া কোথা থেকে আসে সেই হিসাব আপনাকে দেব?’ সায়েম বলেন, ‘অবশ্যই দেবেন।’ 

এ সময় সোহাগ দুই তিনবার বলেন, ‘আমার বাপ টাকা দেয়।’ সোহাগের পক্ষ থেকে অনেকেই বলেন, ‘শুধু বাসা ভাড়া নিয়ে এভাবে কথা বলছেন কেন?’ তখন সায়েম বলেন, ‘এটা একটা উদাহরণ মাত্র। তাদের লাইফস্টাইলের একটা ধারণা দিলাম।’

সাধারণ সম্পাদক জাকির বলেন, ‘কোথা থেকে টাকা আসে বলেন?’ সায়েম বলেন, ‘অনেক জায়গা থেকে টাকা আসে। ছাত্রলীগের নামে অনেকেই টাকা দেয়।’ জাকির বলেন, ‘কে কে টাকা দেয়?’ এ সময় সভাস্থলে ব্যাপক হট্টগোল সৃষ্টি হয়। পরে জাকির বলেন, ‘মাসে দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকা আমাদের নেত্রী দেন।’ সায়েম খান বলেন, ‘এই টাকার হিসাব এতদিন দেন নাই কেন? আমি এই টাকার এক টাকাও তো পাই না।’ তখন সোহাগ ক্ষিপ্ত হয়ে আবার বলেন, ‘আমার বাপের টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দেই।’

এরপর জাকির বলেন, ‘আমাদের কি আপনারা নেতা বানাইছেন? আমরা সারাদেশের নেতাকর্মীদের ভোটে নির্বাচিত হইছি। আমরা যদি ব্যর্থ হই, এখান থেকে আমরা বিদায় নেব। আমরা দায়িত্ব পালন করতে চাই না। আপনি যেহেতু জয়েন্ট সেক্রেটারি আমার পোস্ট আপনাকে দিতে চাই। আপনি আমাদের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কথা বলেন!’ সায়েম বলেন, ‘পার্সোনাল কেন? সংগঠনের জন্য যা টাকা আসে তার ভাগ চাইছি।’ তখন সোহাগকে উদ্দেশ্য করে সায়েম খান বলেন, ‘এভাবে করলে আমাকে বহিষ্কার করে দেন। কোনো সমস্যা নাই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারির কেবল ভবিষ্যৎ আছে, আর নেতাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই?’

সভাস্থলজুড়ে ব্যাপক হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষের দিকে তেড়ে যায়। সভাস্থলজুড়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এ সময় জাকির বলেন, ‘ঈদ পারপাসে কে কে টাকা দিয়েছে- তার তালিকা আমরা চাই।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘তমার মালিক (তমা কন্সট্রাকশন) টাকা দেয়। তখন সোহাগ বলেন, ‘আমরা তো সেই টাকা পাই নাই।’ তখন সায়েম বলেন, ‘তাহলে ছাত্রলীগের নামে কারা টাকা নেয়?’

তখন সোহাগ বলেন, ‘চব্বিশ’ ভোটে কিন্তু আমি নির্বাচিত সভাপতি। অতএব কথা বললে ওইভাবে বলবেন। আপনি কিন্তু নির্বাচিত না।’ তখন সায়েম খান বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার অনুমোদিত।’ এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের ফান্ড সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। আমি যদি সংগঠনবিরোধী কিছু করে থাকি আমাকে বহিষ্কার করা হোক।’

এ সময় আবার হট্টগোল সৃষ্টি হয়। সায়েম খানকে কটূক্তি করে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের একান্ত অনুসারীরা নানা কটূক্তি করেন। এ সময় সিনিয়র কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘তাকে কিছু বলতে হলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বলবেন। এভাবে জুনিয়রদের অপমানজনক ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলাটা শিষ্টাচারবহির্ভূত।’ এভাবেই অনানুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য শেষ করেন সায়েম খান।

এমএইচ/ওআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।