ছাত্রদের দল হবে ‘মধ্যপন্থি’, ২৫ ফেব্রুয়ারি আসতে পারে ঘোষণা

• যোগ দিতে পারেন সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ীরা
• থাকবে তরুণ্যের অগ্রাধিকার
• অর্থ জোগানের অন্যতন উৎস ‘ক্রাউড ফান্ডিং’
• থাকতে পারেন ফ্যাসিবাদবিরোধী কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা
• থাকবে নারীর অংশগ্রহণ
• নির্বাচনের জন্য চাপ দেবে না নতুন দল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভার নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয় ছাত্র প্রতিনিধিত্ব। এবার ছাত্রদের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ ঘটছে নতুন রাজনৈতিক দলের।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে তারুণ্যনির্ভর এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন এ দলটি সামনে আসতে পারে।
নতুন রাজনৈতিক দলটির মডেল কেমন হবে, কীভাবে পরিচালিত হবে এবং দলের গঠনতন্ত্র কেমন হবে, এরকম নানান বিষয়ে এ মুহূর্তে চলছে গুঞ্জন। এসব বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, নতুন রাজনৈতিক দলটি ডান, বাম বা ইসলামপন্থি না হয়ে মধ্যপন্থাকে বেছে নেবে। যেখানে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশপন্থা। অর্থাৎ যারা এ দলের রাজনীতি করবেন তারা বাংলাদেশপন্থি হয়েই রাজনীতি করবেন। তবে দেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম দলে টানতে থাকবে বিশেষ কিছু কৌশল৷ এজন্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক দলের গঠন ও কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ৷ নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণদের সেন্টিমেন্ট বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা হবে।
আরও পড়ুন
- ছাত্রদের নতুন দল ফেব্রুয়ারিতেই, টার্গেট বিএনপির ভোট ব্যাংক
- নতুন দলের জন্য নাম-প্রতীক চেয়েছেন শিক্ষার্থীরা
- সরকারে থেকে দল গঠন করলে মেনে নেবে না দেশের মানুষ: ফখরুল
সূত্র বলছে, জাতীয় নাগরিক কমিটির একটি বিশেষ টিম এবং কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টি ও দেশটির অনেক পুরোনো দল জাস্টিস পার্টি, পাকিস্তানে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং ভারতের অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম-আদমি পার্টিসহ আরও বেশ কয়েকটি দলের গঠন, পূর্বের পরিকল্পনা বিচার-বিশ্লেষণ করে এমন একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে, যেন দেশের তরুণ প্রজন্ম দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়।
যারা যোগ দেবেন নতুন দলে
ছাত্রদের নতুন এ দলে যোগ দিতে পারেন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা, সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীরা৷ এছাড়া আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন ছোট ছোট রাজনৈতিক দল যারা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছে তাদের একটি অংশও নতুন দলে যোগ দেবে বলে নাগরিক কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছে৷
নতুন রাজনৈতিক দলটি সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দিতে চায়। সংস্কার বলতে তারা এমন কিছু বোঝাচ্ছেন যেন বাংলাদেশের মানুষকে ভোটের জন্য আর জীবন দিতে না হয়৷ এজন্য সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন৷ সংবিধান সংস্কারের জন্য ছাত্রদের নতুন দলটি ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ চাইবে।
নতুন দলটিতে কাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, কাকে কোন পদে রাখা হবে সেসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে৷ এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের এই রাজনৈতিক দলে যোগদানের পর তাদের আগের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভাব ফেলবে কি না সেসব বিষয়েও সতর্ক থাকছে জাতীয় নাগরিক কমিটি৷
নতুন দলের অর্থের জোগান আসবে যেভাবে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অর্থের চাহিদা বিভিন্নভাবে মিটিয়ে থাকে৷ যার মধ্যে সদস্য বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেওয়া অর্থ, মাসিক বা বাৎসরিক চাঁদা এবং ক্রাউড ফান্ডিং অন্যতম। আত্মপ্রকাশ হতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের অর্থের অন্যতম জোগানদাতা হবে ক্রাউড ফান্ডিং। অর্থাৎ দেশের জনগণ ও সমর্থক চাইলে দলে অর্থ দিতে পারবেন এবং সেটি হবে প্রকাশ্যে।
এছাড়া পদধারীদের মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করা ছাড়াও যে কেউ চাইলে দলটির জন্য অর্থ দিতে পারবেন। তবে এসব অর্থের হিসাব থাকবে এবং কে কত টাকা দিয়েছে তা জনগণ জানতে পারবে৷ জাতীয় নাগরিক কমিটির একটি সূত্র জানায়, অর্থ জোগানের বিষয়টি এমনভাবে চিন্তা করা হচ্ছে যেন স্বচ্ছতা থাকে, জনগণ যেন সবকিছু জানার অধিকার রাখে।
বিলুপ্ত হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন!
নতুন দল গঠনের মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্ত হতে পারে৷ এ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে মিলে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করছেন৷ সংগঠনটির দ্বিতীয় সারির নেতারা নতুন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটাবেন৷ ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হবে এই ছাত্র সংগঠন।
নতুন দলে পদধারীদের মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করা ছাড়াও যে কেউ চাইলে দলটির জন্য অর্থ দিতে পারবেন। তবে এসব অর্থের হিসাব থাকবে এবং কে কত টাকা দিয়েছে তা জনগণ জানতে পারবে৷
সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চাইবে না নতুন দল
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। তারা বলছে, সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া৷ তাই নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছে বিএনপি।
এদিকে, আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলটি সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দিতে চায়। সংস্কার বলতে তারা এমন কিছু বোঝাচ্ছেন যেন বাংলাদেশের মানুষকে ভোটের জন্য আর জীবন দিতে না হয়৷ এজন্য সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন৷ সংবিধান সংস্কারের জন্য ছাত্রদের নতুন দলটি ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ চাইবে।
নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে
নতুন রাজনৈতিক দলে নারীদের মূল্যায়ন করা হবে৷ দীর্ঘদিন ধরে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং মাঠে সক্রিয় ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন নারী নতুন দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীরা যেন দলটিতে যুক্ত হতে পারেন সে বিষয়েও কর্মপরিকল্পনা চলছে৷
লংমার্চের মাধ্যমে দল ঘোষণা আপাতত হচ্ছে না
শুরুতে লংমার্চের মাধ্যমে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার পরিকল্পনা থাকলেও আপাতত সেটি হচ্ছে না বলে নাগরিক কমিটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। তবে কোথায় দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটবে সেটি এখনো চূড়ান্ত করা না হলেও প্রথম পছন্দে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার৷ যেখান থেকে ছাত্ররা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণা করেছিলেন।
সংস্কার প্রক্রিয়া নির্বাচনেরই একটি অংশ। দেখা গেলো, অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি নির্বাচন খুব ভালো হলো। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমরা কোনো ফলাফল দেখবো না। কারণ, এ নির্বাচনটা হয়তো ভালো হলো, কিন্তু পরবর্তীকালে যে সরকার আসবে...সবারই ক্ষমতা না ছাড়ার প্রবণতা থেকে যাবে।- মনিরা শারমিন
দলের দ্বিতীয় শীর্ষপদ নিয়ে ‘মতানৈক্য’
নতুন দলে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আহ্বায়ক বা সভাপতি হবেন, এটি অনেকটাই নিশ্চিত। তবে দ্বিতীয় শীর্ষ পদ সদস্য সচিব বা সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে তৈরি হয়েছে মতানৈক্য। পদটি নিয়ে কয়েকটি পক্ষ তৈরি হয়েছে, যা গত কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।
আরও পড়ুন
- আখতারকে সরাতে চায় কারা, হঠাৎ কেন আলোচনা?
- ফেব্রুয়ারি-মার্চজুড়ে ছাত্র-জনতার দখলে থাকবে রাজপথ: নাহিদ
- ক্ষমতার ছায়াতলে থেকে নতুন দল করলে জনগণ মানবে না
দলটির সাধারণ সম্পাদক পদে নাগরিক কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, বর্তমান সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদের নাম শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে৷ মূলত এ পদটি নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে৷ অভিযোগ উঠেছে, নতুন দলে বেশ কয়েকজন নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শের নিজস্ব বলয় তৈরি করতে চাচ্ছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন জাগো নিউজকে বলেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ যেন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি সেজন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি৷ দলটি হবে মধ্যমপন্থি৷ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মই আমাদের টার্গেট পপুলেশন। তরুণদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেলে গঠিত হবে নতুন দল।
তিনি বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়া নির্বাচনেরই একটি অংশ। দেখা গেলো, অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি নির্বাচন খুব ভালো হলো। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমরা কোনো ফলাফল দেখবো না। কারণ, এ নির্বাচনটা হয়তো ভালো হলো, কিন্তু পরবর্তীকালে যে সরকার আসবে...সবারই ক্ষমতা না ছাড়ার প্রবণতা থেকে যাবে।
‘তখন আবারও আমরা ভোট দিতে পারবো না। ভোটাধিকার হরণ করা হবে। বারবার তো আর মানুষ ভোটের জন্য রক্ত দেবে না। আমরা চাই এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকুক। এজন্য আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই এবং এর মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার চাই’- বলেন মনিরা শারমিন।
এনএস/এমকেআর/এমএস