কৃষকের ছেলে আজ সেরা পেসার
তিনি যা করেন, সেই পেশায় যেন কোনোদিন না আসতে হয় তার ছেলেকে। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের এক কৃষক। নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য চেষ্টার কসুর করেননি তিনি। স্বপ্ন সফল করার প্রাথমিক ধাপে পা রাখতে পেরেছেন তিনি। এখন সেই কৃষকের পরিচয় উদীয়মান ক্রিকেটার কার্তিক ত্যাগীর বাবা হিসাবে।
-
অনূর্ধ্ব ১৯ যুব বিশ্বকাপে ভারতকে সেমিফাইনালে তোলার অন্যতম কারিগর কার্তিক। উত্তরপ্রদেশের অখ্যাত গ্রাম ধানাউরার এই তরুণের আগুনে গতিতে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৭৪ রানে উড়িয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ভারত। আগে ব্যাট করে ভারতের স্কোর ছিল ২৩৩-৯। জবাবে অস্ট্রেলিয়া শেষ হয় ১৫৯ রানে। কার্তিক নেন ২৪ রানে চার উইকেট। সেমিফাইনালেও পাকিস্তানের দুই উইকেট নিয়ে ভারতকে ফাইনালে তুলতে সাহায্য করেছেন তিনি।
-
আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয় পরিবারের মতো কার্তিকের বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে উচ্চশিক্ষিত হোক। কিন্তু স্কুলের পাঠ কিছুদূর এগোতেই বুঝলেন তার ছেলের পড়াশোনায় কোনো মন নেই।
-
কিন্তু পারিবারিক পেশা কৃষিকাজে কার্তিককে আনার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তার বাবা ও কাকার। গ্রামের রাস্তায় কার্তিককে খেলতে দেখে তাকে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দেন তারা।
-
কৈশোরে পা দেয়ার আগেই শুরু হল কার্তিকের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মেরঠে ছিল তার কোচিং। প্রবীণ কুমার ও ভুবনেশ্বর কুমার ওই প্রতিষ্ঠানেরই ফসল।
-
কোচ বিপিন ভাটের প্রশিক্ষণে সুযোগ পেতে দেরি হল না কার্তিকের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ২০১৭-১৮ মরসুমের রনজি ট্রফিতে। এখনও অবধি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন কার্তিক। রেলওয়েজের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ৪০ রানে ৩ উইকেট পান। রান করেন ১১।
-
লিস্ট এ ম্যাচ খেলেছেন ৫টি। উইকেট শিকার ৯টি। এই পারফরম্যান্সের সুবাদেই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সুযোগের দরজা খুলে যায় এই তরুণ তুর্কির সামনে। ২০২০ সালের আইপিএল-এ তিনি খেলবেন রাজস্থান রয়্যালস-এর হয়ে।
-
গত ২৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকার পোচেস্ট্রুমে ভারতীয় ব্যাটিংয়ে শুরুতে যশস্বী জয়সোয়াল (৬২) এবং পরে অথর্ব আঙ্কোলেকর (৫৫) ছাড়া বড় রান আর কেউ পাননি। ইনিংসের বিরতিতে মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে হয়তো এই রান তাড়া করা বিশেষ কঠিন হবে না। কিন্তু প্রথম ওভারেই দু’উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংকে নড়িয়ে দেন কার্তিক। প্রথম স্পেলেই তুলে নিয়েছিলেন তিন উইকেট।
-
পরে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে ভাঙেন অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম উইকেটের জুটি। বাকি কাজটা করে দেন আকাশ। এই বাঁ-হাতি পেসারের ইয়র্কারে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যানের স্টাম্প ছিটকে যাওয়া মাত্র বিশ্বকাপ জয়ের আরও এক ধাপ কাছে চলে আসে ভারত। চার উইকেট নেওয়ায় ম্যাচের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন কার্তিক।
-
অথচ দু’বছর আগেও জীবন এত মসৃণ ছিল না। লাগাতার চোট আঘাতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল ক্রিকেট খেলা নিয়েই। অনটনের সংসারে কষ্ট করেই সংস্থান হয় চিকিৎসার।
-
হাজার অসুবিধে সত্ত্বেও কার্তিককে কোনওদিন মাঠের কাজে হাত লাগাতে বলেননি তার বাবা। চাষবাস থেকে এতটাই দূরে রাখতে চেয়েছেন ছেলেকে, কার্তিক জানেনই না তার বাবা কী কী ফসল চাষ করেন।
-
চাষবাসের মাঠের পরিবর্তে ক্রিকেটের মাঠই হোক কার্তিকের জীবন। বাবার এই স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দিতে চান না উনিশ বছরের কার্তিক। মনে করেন, ফাস্ট বোলার হওয়া শুধুমাত্র কোনো ক্যারিয়ার নয়। বরং, একটা অ্যাটিটিউড।
-
তারপরেও জীবনকে দেখেন বাইসাইকেলের চাকার মতো। যেখানে ওঠাপড়া আসে হাত ধরাধরি করে। বাবার কথামতো প্রত্যেক ভাল পারফরম্যান্সের সাফল্য পরদিন ভুলে যান কার্তিক। প্রতিটা দিন শুরু করেন নতুন করে।
-
যশ, খ্যাতি, পরিচয়ের পাশাপাশি আরও একটা গুরুত্বপ্র্ণূ জিনিস ইতিমধ্যেই কার্তিককে দিয়েছে ক্রিকেট। অনটনের সংসারে এসেছে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি ২০২০ আইপিএল মৌসুমে খেলবেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে।
-
তিন বছর আগেও আইপিএল নিলামে ছিলেন কার্তিক। কিন্তু তখন তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। অথচ, এবার তাকে নেয়ার জন্য লড়াই করেছে কিংস পাঞ্জাব ইলেভেন পাঞ্জাব আর রাজস্থান রয়্যালস।
-
আইপিএল নিলামের পরে কার্তিকের গ্রামে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা বাজনা বাজিয়ে তার বাবাকে কাধে বসিয়ে সারা গ্রামে শোভাযাত্রা করেন। এই আবহ থাকুক ক্যারিয়ারের আগামীতেও, এটাই এখন প্রার্থনা ত্যাগী পরিবারের।