চাঁদের মাটিতে রয়েছে যে ব্যক্তির দেহভস্ম
চাঁদ পৃথিবীর সবার কাছে স্বপ্নে বিষয়। তাই এই মানুষটির সবার মত চাঁদের মাটিতে পা রাখার ইচ্ছে ছিল জীবনভর। কিন্তু সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি। সশরীরে পৌঁছতে পারেননি পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহে। তবে পৌঁছেছিলেন মৃত অবস্থায়। তিনি, বিজ্ঞানী ইউজিন শুমেকার। জেনে নিন তার সম্পর্কে।
-
শুমেকার ছিলেন আদতে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক। কিন্তু তার বিস্তৃত গবেষণা জন্ম দিয়েছিল বিজ্ঞানের নতুন শাখার, ‘প্লানেটরি সায়েন্স’ বা ‘প্লানেটোলজি’।
-
তার জন্ম ১৯২৮ সালের ২৮ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাবা, জর্জ শুমেকার জীবনে বহু পেশায় ছিলেন। কখনো কৃষিকাজ, কখনও শিক্ষকতা, কখনো ব্যবসা, নানাভাবে উপার্জন করেছেন জর্জ। মা, মারিয়েল ছিলেন শিক্ষিকা।
-
মায়ের চাকরি সূত্রে ইউজিনের শৈশবের বড় অংশ কেটেছিল আমেরিকার বাফেলো শহরে। বাফেলো মিউজিয়ম অব এডুকেশন-এর পাথর ও খনিজ সংক্রান্ত বিশেষ কোর্স তার জীবনের দিক নির্দেশক। ওই কোর্সের পরেই তিনি শুরু করলেন খনিজের নমুনা সংগ্রহ।
-
১৯৪২ সালে শুমেকার পরিবার আবার ফিরে আসে লস অ্যাঞ্জেলসে। সেখানে ফেয়ারফ্যাক্স হাই স্কুল থেকে ইউজিন ষোলো বছর বয়সে শেষ করলেন হাই স্কুলের পাঠ। ১৯৪৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে, উনিশ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েশন।
-
১৯৫১ সালে বন্ধু রিচার্ডের বোন ক্যারোলিনকে বিবাহ করেন ইউজিন। ভূতত্ত্ব নিয়ে তার আলোচনা শুনেই আকৃষ্ট হন ক্যারোলিন। বলেছিলেন, নীরস বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জেগেছিল ইউজিনের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা শুনেই।
-
বিয়ের পরে সংসার এবং তিন সন্তান নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন ক্যারোলিন। সন্তানরা বড় যাওয়ার পরে স্বামীর পরামর্শেই অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে পড়াশোনা। কঠোর অধ্যবসায়ের জেরে একান্ন বছর বয়সে ক্যারোলিন নতুন করে পথ চলা শুরু করেন প্লানেটরি অ্যাস্ট্রোনমার হিসেবে। তিনি এখনো কাজ করে চলেছেন।
-
ইউজিন ও ক্যারোলিনের যৌথ গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছিল ৭১টি ধূমকেতু এবং ৮০০ গ্রহাণু। বিশ্বের ইতিহাসে এই আবিষ্কার বিরল ও নজিরবিহীন। বন্ধু বিজ্ঞানী ডেভি, স্ত্রী ক্যারোলিনের সঙ্গে গবেষণায় ১৯৯৩ সালে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন ইউজিন। তার নামকরণ হয় শুমেকার লেভি-৯।
-
ইউজিন শুমেকারের পূর্বাভাস ছিল, এই ধূমকেতু খুব তাড়াতাড়ি আছড়ে পড়বে বৃহস্পতি গ্রহে। তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণিত হয় ১৯৯৪ সালের ১৬ জুলাই। পৃথিবী জুড়ে নতুন করে আলোচিত হয় বিজ্ঞানী শুমেকারের নাম।
-
পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা ধরনের গহ্বর ছিল পিএইচডি-তে ইউজিনের বিষয়। গহ্বর নিয়ে তার সেই অনুসন্ধান বজায় ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ডের আঘাতে পৃথিবীতে যা গহ্বর তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে ইউজিনের গবেষণায় উপকৃত হয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা।
-
নাসার অ্যাপোলো-১১ মিশনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ইউজিন। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন হবু মহাকাশচারীদের। চাঁদে প্রথম মানুষ পৌঁছনোর অভিযানে তিনিও ছিলেন সম্ভাব্য অভিযাত্রী। তিনি নিজেও জানতেন, প্রথমবার পৃথিবী থেকে যারা চাঁদের মাটিতে পা রাখবেন, তাদের মধ্যে থাকবেন তিনিও।
-
কিন্তু তার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল অ্যাডিসন ডিজিজে। অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থির এই অসুখের জন্য তিনি মনোনীত হননি চন্দ্র অভিযানের অভিযাত্রী হিসেবে। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নাসার কার্যালয়ে বসে বাইরে থেকেই চাঁদের পিঠে মানুষের প্রথম পদচারণা দেখেছিলেন অভিযানের অন্যতম হোতা ইউজিন শুমেকার।
-
স্বপ্নভঙ্গ তাকে সরিয়ে আনতে পারেনি বিজ্ঞানসাধনার পথ থেকে। সেই সাধনার অঙ্গ হিসেবেই ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সস্ত্রীক পৌঁছেছিলেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্ত ট্যানামি ট্র্যাকে।
-
উল্কাপিণ্ডের আঘাতে তৈরি হওয়া নতুন গহ্বরের সন্ধানে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন শুমেকার ও তার স্ত্রী ক্যারোলিন। কিন্তু এ যাত্রা পূর্ণ হল না নতুন আবিষ্কারের স্বপ্ন। ট্যানামি ট্র্যাকে শুমেকারের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় উল্টো দিক থেকে আসা দ্রুতগতির একটি গাড়ির। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ইউজিন শুমেকার। গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী, ক্যারোলিন।
-
ইউজিনের মৃত্যুর পরে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিজ্ঞানী ক্যারোলিন পোর্সো এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক করেন, জীবিত অবস্থায় যেতে না পারলেও মৃত্যুর পরে চাঁদে পৌঁছবেন ইউজিন শুমেকার। তার নশ্বর দেহ দাহ করা হল। সংগ্রহ করা হল একমুঠো ভষ্ম।
-
১৯৯৮ সালে চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল নাসার লুনার প্রসপেক্টর। সেই মহাকাশযানেই একটি পলি কার্বোনেটের ক্যাপসুলে পিতলের আধারে রাখা হয় ইউজিনের চিতাভস্ম। আধারে লেখা ছিল, নাম, জন্ম ও মৃত্যুতারিখ এবং ‘রোমিও জুলিয়েট’-এর একটি অংশ।
-
১৯৯৯ সালের ৩১ জুলাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি গহ্বরে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করানো হয় ‘লুনার প্রসপেক্টর’-কে। আঘাতের অভিঘাতে খণ্ডিত প্রসপেক্টর থেকে বেরিয়ে আসে ক্যাপসুল। চাঁদের মাটিতে মিশে যায় ইউজিন শুমেকারের চিতাভস্ম।
-
নশ্বর দেহে চাঁদে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু পৃথিবী থেকে একমাত্র তিনিই চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছেন চাঁদের মাটিতে। এই পরম আশ্রয় থেকে কেউ তাকে অন্য কোথাও সরাতে পারবে না।