দেশে দেশে বাজ খেলা
ধূ-ধূ মরুভূমি। মাথার ওপর আগুন ছড়াচ্ছে নির্দয় সূর্য। উঁচু একটা বালির ঢিবির ওপর এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা। পরনে তার আরবদের চিরাচরিত পোশাক। চারিদিকে সর্তক নজর বুলালো যাযাবর বেদুইন। দিগন্ত বিস্তৃত বালির সাগরে নড়ে-চড়ে উঠলো কী যেনো? ওটা কি? বাঁ হাতটা সামান্য উপরে উঠলো তার। এমনই বাজ খেলার দৃশ্য। এই বাজ খেলা নিয়ে লিখেছেন শেখ আনোয়ার।
-
সচকিত হলো কাঁধের ওপর বসা বিশাল পাখিটা। মানুষটার উত্তেজনা টের পেয়ে গেছে পাখিটা। বেদুইনের ঘাড়ের রোমগুলোতে ফুলে ফুলে উঠছে কী এক আক্রোশ। পাখির চোখ জোড়ায় শিকারীর দৃষ্টি। সাধারণ কোন চোখ নয় ওটা। মানুষের চেয়ে সাত-আট গুণ বেশি পাওয়ারফুল। ভালো দেখতে পায় ওই ইন্দ্রিয়। ছবি: সংগৃহীত
-
তিন হাজার ফুট দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পায় যে কাউকে। কিন্তু এখন-এই মুহূর্তে কেউ একজন ধরা পড়েছে তার ওই ভয়ঙ্কর দৃষ্টির সীমানায়। এমন কেউ, যে জানে না, মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে খুব শিগগিরই। এবার ইশারা ভাষায় আলতোভাবে দ্বিতীয়বার কাঁধ ঝাঁকালো আরব বেদুইন। ছবি: সংগৃহীত
-
মুহূর্তে বিদ্যুৎ গতিতে বাজ উড়ে উধাও হয়ে গেলো শুন্য আকাশে। তারপর কয়েক সেকেন্ডেই ছোঁ মেরে শিকারকে ধারালো পায়ের নখে বন্দী করে মালিকের কাছে ধরে আনলো। এরই নাম বাজ খেলা। ছবি: সংগৃহীত
-
বাজ খেলার ইংরেজি নাম ফ্যালকনরি। শিকার করার সুপ্রাচীন এক খেলার নাম বাজ খেলা। মানুষের হাত থেকে ইঙ্গিত পেয়ে অনেক দূরে ধেয়ে যায় পোষা বাজপাখি। মুহূর্তে শিকারকে বধ করে ধরে নিয়ে আসে তার মালিকের কাছে। ছবি: সংগৃহীত
-
না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মানুষ আর পাখির মাঝে অদ্ভূত রাডারের মতো এক যোগাযোগ ঘটে এ সময়ে। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে অভিজ্ঞ ফ্যালকনার বা বাজ পাখির উস্তাদ- প্রশিক্ষক। যে কোনো সময় তার সামান্য ইঙ্গিতে মাঝ আকাশ থেকে ফিরে আসে বাজ পাখি। ছবি: সংগৃহীত
-
মালিকের হাতের ওপর বসে পড়ে আবার। পরক্ষণেই নির্দেশ পেয়ে হয়তো আবার উড়ে যায় আকাশে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘এই বাজ পাখির গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ মাইল। অন্য কোন পাখি এতো দ্রæতবেগে উড়তে পারে না। অবাক হলেও সত্যি, এই বাজ পাখির নাক, মুখ, ঠোঁট ও পাখার আকার-আকৃতি অনুকরণ করে বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রকৌশলীরা জেট ইঞ্জিন নির্মাণের নকশা করেছেন।’ ছবি: সংগৃহীত
-
বাজ খেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। অনেকেই বলে থাকেন, মানব সভ্যতার বিকাশের পর পরই এই বাজ খেলা চলে এসেছে। আবার কেউবা বলেন, বাজ খেলার ইতিহাস দশ হাজার বছরেরও আগের। জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যে ঐতিহাসিকভাবে বাজ খেলা খুবই জনপ্রিয় ছিলো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাধারণ খেলাধুলার মতোই বাজ খেলা ছিলো এক আভিজাত্য। ছবি: সংগৃহীত
-
আরবের অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার বাজ খেলার প্রশংসা করে অনেক কবিতা-সাহিত্য রচনা করে গেছেন। তবে মরুভূমির যাযাবর বেদুইনরা বাজ পাখি শিকারের কাজে ব্যবহার করতো না। তারা বাজপাখি দিয়ে প্রতিযোগিতা খেলা খেলতো। বলা হতো, মরুবাসীদের জীবন বাঁচানের উপায় হলো এই বাজ খেলা। ছবি: সংগৃহীত
-
খ্রিষ্টের জন্মের ৬শ বছর আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ- আরব, ইরান-ইরাক, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ পারস্য ও আরব উপসাগর, লিবিয়া, মিসর ও আফ্রিকার মরু জঙ্গল এলাকায় ব্যাপক ঐহিত্যপূর্ণ খেলা হিসেবে পরিচিত ছিলো এই বাজ খেলা। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তুর্কিস্তানে সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিলো বাজপাখির এই শিকারের খেলা। ধীরে ধীরে আরব উপসাগরে বাজ খেলা প্রসিদ্ধি লাভ করে। ছবি: সংগৃহীত
-
জানা যায়, উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং হিশাম বিন আব্দুল মালেক এই বাজ খেলা খুবই পছন্দ করতেন। আব্বাসীয়দের শাসনামলে এই বাজ খেলার ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে। খলিফা হারুন উর রশিদ নিজে বাজ খেলায় প্রচণ্ড অনুরক্ত ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রনায়কদের বাজপাখি উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতেন। ছবি: সংগৃহীত
-
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে বাজপাখি এক সময় রীতিমতো কূটনৈতিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হতো। ওসব অঞ্চলে দেশে-দেশে, রাজায়-রাজায় একজন-আরেকজনের কাছে উপহার হিসাবে পাঠাতেন শিকারী এই বাজপাখি। ইতিহাসের পাতায় বাজ উস্তাদ প্রশিক্ষকদের প্রভু হিসাবে যে নরপতির নাম সবচেয়ে বেশি উল্লেখ রয়েছে, তিনি জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় ফেডারিক। ছবি: সংগৃহীত
-
অত্যন্ত জ্ঞানী লোক ছিলেন তিনি। প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপর ছিলো তার অগাধ পড়াশোনা। পাখি বিশারদ হিসাবে নাম কুড়িয়েছিলেন অনেক। দেশ-দেশান্তরে পাখিদের আনাগোনা নিয়ে সর্বপ্রথম তিনিই গবেষণা চালান। বাজপাখির খেলার ওপর তিনি লিখেছেন ‘দ্য আর্ট অব ফ্যালকনরি’ নামক বিখ্যাত বই। ছবি: সংগৃহীত
-
খ্রিষ্টের জন্মের ৭০০ বছর আগে জাপান-কোরিয়া অঞ্চলে সেনাবাহিনীদের অনুষঙ্গ ছিলো এই বাজ খেলা। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে চীনে। চীনে শিকারী বাজের ইতিহাস সুপ্রাচীন। চীনের রাজনীতি ও ক্ষমতার মধ্যে বাজ খেলার যোগসূত্র রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
-
মঙ্গোলিয়ান সেনাবাহিনীতে হাজার বছর আগে থেকেই উঁচুমানের প্রশিক্ষণ হিসেবে বাজ খেলা প্রশিক্ষণে সেনা সদস্যদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হতো। এই বাজ শিকারী সেনাদের মাধ্যমেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হতো। ছবি: সংগৃহীত