ক্যান্সার আক্রান্ত যে নারী শতাধিক শিশুদের খাবার দিচ্ছেন
অনাহার, গার্হস্থ্য হিংসা, ছোট বোনের মৃত্যুর বিচার ছোটবেলাটা এ সব নিয়েই টালমাটালে কেটেছিল তার। পরিবারে অভাব এতটাই ছিল যে, অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। এগুলো পেরিয়ে যখন মাথা তুলে একটু শ্বাস নিচ্ছিলেন, ফের আর এক অভিশাপ ক্যান্সার নেমে এল তার জীবনে। জেনে নিন এমনই এক ক্যান্সার আক্রান্ত নারীর কথা যিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করেও শতাধিক শিশুর মুখে খাবার দিচ্ছেন।
-
মারণ রোগ শক্ত কামড় বসিয়ে দিল তার জীবনে। কিন্তু সেটাও নড়াতে পারেনি তাকে। নিজের কথা না ভেবে বস্তির শিশুদের মুখে খাবার তুলে চলেছেন তিনি। ওই শিশুগুলোর ‘সুপারহিরো’ আঁচল।
-
ভারতের দিল্লির রংপুরীর একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আঁচল শর্মার জন্ম। বাবা-মা আর তিন ভাইবোন তারা। বাবা ছিলেন একজন অটোচালক। অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে উপার্জনের সমস্ত টাকা একটি গাড়ি কিনতে খরচ করে ফেলেন। কিন্তু গাড়ির ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেননি তিনি। এ দিকে অটো চালানোর কাজটাও চলে যায়।
-
হতাশ হয়ে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে যান তিনি। দারিদ্র থাকলেও সংসারে শান্তি ছিল। বাবার কাজ হারানোর পর থেকে সেই শান্তিটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। রোজ মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে আঁচলের মাকে বেধড়ক মারধর করতেন তিনি।
-
তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়েই একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন আঁচলের মা। সারাদিন পরিশ্রমের পর সামান্য বেশি রোজগারের জন্য দিনের পর দিন অতিরিক্ত সময়েও কাজ করেছেন। কিন্তু সে কাজও বেশি দিন টেকেনি।
-
বাড়িতে খাবার থাকত না সে সময়। দিনের পর দিন অনাহারেই কাটিয়েছেন আঁচলরা। কখনো কখনো একটি বা দুটো রুটি মরিচের গুঁড়ো দিয়ে রোল করে খেয়ে নিতে হয়েছিল তাদের। সেটাই তখন তাদের কাছে এলাহি খাবার।
-
আঁচল তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন আর তার দাদা নবম শ্রেণিতে। মাইনে দিতে না পেরে দু’জনকেই স্কুল ছাড়তে হয়। দাদা কাছের একটি মোটর গ্যারেজে কাজ শুরু করেন। আঁচলও একটি সংস্থার রিসেপশনিস্টের কাজ পান। অনেকটা উন্নতি হয় পারিবারিক পরিস্থিতির।
-
সে সময় প্রতি মাসে ৪০০০ টাকা মাইনে পেতেন তিনি। পড়াশোনা না জানা তার ক্যারিয়ারে বাধা হতে পারেনি। দ্রুত সব কিছু শিখে নিয়েছিলেন তিনি।
-
এমনকি ইংরেজি বলাটাও খুব সুন্দর রপ্ত করে নিয়েছিলেন। নিজের চেষ্টায় ক্রমে ক্যরিয়ারের গ্রাফ উপরে তুলেছেন। প্রমোশান পেয়েছেন, এমনকি একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন নিজের উপার্জনে। অত্যন্ত লড়াকু এই মেয়েটা কখনো নিজের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বিলাপ করেননি।
-
তার বোন একটি ছেলেকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু বাবা-মা কিছুতেই তা মানতে চাইছিলেন না। আঁচলই মধ্যস্থতা করে, খরচ করে বিয়ে দেন বোনের। দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটছিল তার।
-
কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যে বোনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ, তার স্বামীই তাকে খুন করেন। এতদিন যে শক্তি নিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন, সেই আঁচল কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বোনের মৃত্যু। বিধ্বস্ত মন নিয়েও বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
-
বিয়েটা আঁচলেরও ভালো হয়নি। বাবা-মা এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দিয়েছিলেন তার। কিন্তু পর দিন থেকেই মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তিন মাসের মধ্যে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। এটাই শেষ নয়, জীবনের প্রতিটা মোড়ে আঁচলকে হোঁচট খেতে হয়েছে, প্রতিটা মোড়ে তাকে আরও বেশি মনের জোর নিয়ে লড়ে যেতে হয়েছে।