৬ এমডি বাড়িতে ব্যাংকপাড়ায় কোরামিন

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫

বেছে বেছে বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে হাফ ডজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক- এমডিকে। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দুর্নীতির শিকার ছয় ব্যাংকের আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। ব্যাংকিং সংস্কার টাস্কফোর্সের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আলাদাভাবে তিনটি করে ব্যাংক নিরীক্ষা করবে কেপিএমজি ও আর্নেস্ট ইয়ং নামের দুই প্রতিষ্ঠান।

এই কার্যক্রমে ব্যাংকের এমডিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, আইসিবি ইসলামিক ও ইউনিয়ন ব্যাংক বর্তমান এমডি ও চলতি দায়িত্বে থাকা এমডিদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ব্যাংকিং সংস্কার কমিটির সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেই এ সিদ্ধান্তে আসা হয়। এসব ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউর-একিউআরের আওতায় আনা হবে। অডিটে কোনো অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া না গেলে তাদের আবার ফেরত আনার একপি অপশন রাখো হয়েছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবির সহায়তায় থার্ড পার্টি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুটি অডিট প্রতিষ্ঠানকে। তারা অডিট চলাকালে এমডিদের উপস্থিতি চায় না। কারণ তারা চেয়ারে থাকলে ডিস্টার্ব করার ঝুঁকি থাকে। রবিবার এ সিদ্ধান্তের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে। সেখানে এসব ব্যাংকে অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে এস আলম ঘনিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর শনিবার হলিডেতে জরুরি বোর্ড সভা ডেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। তাকে তিন মাসের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়। এর একদিন পর রবিবার আরো পাঁচ ব্যাংকের এমডিকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

আগস্টে বিগত সরকারের পতনের পর দেশের সর্বত্র ব্যাংকের আমানতকারীরা প্রতিদিন ব্যাংকে হাজিরা দিয়েছেন। তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চেকের বিপরীতে ৫ হাজার টাকার বেশি পরিশোধ করতে পারেনি। গ্রামে কোনো কোনো ব্যাংক থেকে তিন দিন ঘুরে ৫ বা ১০ হাজার টাকা উঠাতে পেরেছেন গ্রাহকরা। মলমে-কোরামিনে তা সারানোর চেষ্টা চলছে। বাকিটা দেখার অপেক্ষা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।

গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে আগে যোগদান করা এমডিরা দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিগত সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের দুর্নীতি, সুখ-সম্ভোগে বেশ কিছু ব্যাংক বিগত কয়েক মাস এক প্রকার আইসিইউতে ছিল। নানা কোরামিনে তাদের যদ্দুরসম্ভব বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সরকার। সংখ্যায় তারা দশের মতো। এসব প্রবলেম বা দুর্বল ব্যাংককে সারিয়ে তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত। রয়েছে সাত হাজার ৩৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তাও। এ ব্যাংকগুলোকে টেনে তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে অন্য সবল ব্যাংক থেকে সাময়িক ধারকর্জে সহায়তা দেওয়া হলেও তেমন সুফল মিলছিল না। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এমডিদের ছুটিতে পাঠানো এবং অডিটের তাগিদ।

ব্যাংকে টাকা জমা রেখে মানুষ সেই টাকা তুলতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই হাহাকার দেখা দেয়। এবার অবস্থাটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। এমন দশা যে একদিনে হয়েছে তা নয়। দিনে দিনে তিলে তিলে ব্যাংকগুলোকে রোগী বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যার জেরে সরকার বিতাড়িত হওয়ার পর অর্থ সেক্টরের হর্তাকর্তাদের কতক ভেগেছেন। অথবা ডুব দিয়েছেন মাইক্রো-মেক্রোর ফের বোঝানো মহাজ্ঞানী মহারথিরা। ওই জল্লাদ গভর্নররা কেবল হুকুম তামিলকারী ছিলেন না, নিজের জায়গায় ছিলেন এক একজন স্বৈরশাসকও।

ব্যাংকগুলোকে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুনের জল্লাদরা জানতেন কী করে মাফিয়াপ্রধান, তার পরিবারবর্গকে খুশি করতে ব্যাংকগুলোর মালিকানা নতুন আইন করে পরিবারকেন্দ্রিক করে দেওয়া যায়। ঋণের নামে, এলসির নামে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা যায়। দেশে দরকার না থাকলেও নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে মাফিয়াগোষ্ঠীকে দিয়ে অর্থ লোপাট করানো যায়। তাদের প্রায় সবাই এখনো অধরা।

এক টাকা নিয়ে স্কুলে যাওয়া, গণখয়রাতে পড়াশোনা করার বয়ান শুনিয়ে রাখালবালক ড. আতিউরের সময় হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক এমন কি হ্যাকিংয়ের নামে রাষ্ট্রীয় টাকা গায়েবের বিহিত হবে? ফজলে কবিরের কথা তো ভুলেই যেতে বসেছে অনেকে। গভর্নর হিসেবে ২০মার্চ ২০১৬ - ৩ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত কী না করেছেন তিনি? মিঠা মিঠা কথায় সুঁইয়ের বদলে কতো কুড়ালই না ঢুকিয়েছেন ফজলে কবির। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে তার জন্য গভর্নরের বয়সকালই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পার্লামেন্টে আইন করে। রাতের কারবারি নামে প্রচারিত এই গভর্নর ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলমকে দিয়ে খাইয়েছেন।

এরপর এস আলম বিনা বাধায় একে একে আরো ব্যাংক খেতে থাকেন। এই ‘গুণী’ ৯/৬ নীতির সুদসহ অর্থখাতে যে সব অপকর্ম করেছেন তা বিচারের আওতায় আনা জরুরি। ১২ জুলাই ২০২২ থেকে ৯ আগস্ট ২০২৪ গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার কী না করেছেন? লুটেরাদের অংশীজন কেরানি গোছের সাবেক এ সচিব গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত ছিলেন। আরো কিছুদিন সময় পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে একটি ভবনের বাইরে আর কী থাকতো? পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছেন মানে জনমের বাঁচা বেঁচে গেছেন? শ্বেতপত্রের হিসাব অনুযায়ী এই ত্রি-রত্নের কল্যাণে ২০০৯ সালের ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ৭ লক্ষ কোটি টাকা হওয়া যা-তা ব্যাপার নয়।

দানবীয় এসব ব্যক্তির কৃতকর্মে পঙ্গু অর্থনীতিতে ধুঁকছে দেশ। তাদের মধ্যে আবদুর রউফ তালুকদার ভেগেছেন বা আত্মগোপনে। বাকি দু’জন ডুব দিলেও আছেন দেশেই। তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা বা অপরাধবোধ জেগেছে –এমন কোনো খবর নেই। এ চক্রের ক্ষত সারাতে এখন সরকারের টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় দশা। আবদুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর অজ্ঞাত কারণে ঋণখেলাপিদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে, এমন একটি সার্কুলার ইস্যু করেন। এটি ব্যাংকের যোগদানের প্রথম সপ্তাহেই ইস্যু করা হয়েছিল। তা দেখে যে কোনো বোকা লোকও বুঝেছিল, ঋণখেলাপিদের সহযোগিতা করার মিশন নিয়েই তার বাংলাদেশ ব্যাংকে আগমন। ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার ওপর মলম হিসেবে তিনি ব্যাংক একীভূতকরণের ফর্মুলা বের করেছিলেন। এই ফর্মুলা প্রয়োগের ফলে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় এবং আমানতকারীরা দ্রুত তাদের আমানত উঠিয়ে নিতে শুরু করেন।

আগস্টে বিগত সরকারের পতনের পর দেশের সর্বত্র ব্যাংকের আমানতকারীরা প্রতিদিন ব্যাংকে হাজিরা দিয়েছেন। তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চেকের বিপরীতে ৫ হাজার টাকার বেশি পরিশোধ করতে পারেনি। গ্রামে কোনো কোনো ব্যাংক থেকে তিন দিন ঘুরে ৫ বা ১০ হাজার টাকা উঠাতে পেরেছেন গ্রাহকরা। মলমে-কোরামিনে তা সারানোর চেষ্টা চলছে। বাকিটা দেখার অপেক্ষা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।