সাংবাদিকতার দায়


প্রকাশিত: ০১:৪২ এএম, ১৬ মে ২০১৬

নিজামীর ফাঁসির সাথে সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটা পর্ব সম্ভবত শেষ হলো। কাল অন্তত  দুজন পরিচিতর সাথে ফোনে কথা হলো। দুজনই "ফেসবুক জগতের" কেউকেটা। সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে তাদের ভীষণ আপত্তি। আমি আপাতত  অফ এয়ার চ্যানেলে। কিন্তু টিভি তো দেখছি। তাদের অভিযোগ বা আপত্তির আবেগটা ধরতে পারছি কিন্তু ভিত্তিটা কমজোরি। একজন বললেন, এই শুয়োরগুলো কি মুক্তিযোদ্ধাদের মারার সময় এতোটা সহানুভূতি দেখিয়েছিল? কি দিয়ে তারা খেয়েছে? স্বজনদের কান্নামাখা মুখ, ভি চিহ্ন-সব দেখাতে হয় কেন আপনাদের? আপনারা আসলে কার পারপাজ সার্ভ করেন?

আমি বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তারা অত বুঝতে টুঝতে নারাজ। একজন বলেন, মুখে যতই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন আপনাদের ল্যাজ কিন্তু বেরিয়েই যায়। কি বলি! ভাইরে, সবার আগে সাংবাদিকতাটা কিন্তু একটা পেশা। নিজামীর ফাঁসির রায়ের খবর দেখতে দেখতে মনে হয়, এবার বেশ গোছানো সবকিছু আগের কয়েকবারের তুলনায়। ছোট্ট একটু জায়গার মধ্যে কয়েকশ টিভি সাংবাদিক, ক্যামেরাপার্সন, আইটিপার্সন, ব্রডক্রাস্টের লোক, প্রোডাকশনের মানুষ, অনলাইন এবং পত্রিকার সাংবাদিক, বিদেশি সাংবাদিক, উৎসুক জনতা। এবং এরমধ্যে আনুষ্ঠানিক এবং সিস্টেমেটিক কোনো উপায় নাই ভেতরে কি হচ্ছে, কখন ম্যাজিস্ট্র্রেট গেল, কখন প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা গেল, আসামীর আত্নীয়-স্বজনরা ঠিক কয়জন দেখা করতে গেল, ঠিক কটায় ফাঁসি হলো-এসব জানার।

রিপোর্টারদের ওই মুহূর্তে হতে হয় জাদুকর। সব তথ্য জাদু দিয়ে বের করতে হয়। এরকম ভিড়ভাট্টার মধ্যে সোর্সও সবসময় ঠিকঠাক কাজ করে না- সাংবাদিক যারা তারা ভালো বলতে পারবেন। এখন এরকম অবস্থায় যা হয়-কনটেন্ট কম থাকলে এমন অনেক কথাই হয়তো বলা হয় যা রিপোর্টাররা মোটেও বলতে চান না। দুএকবার "সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী" এরকম সম্বোধন করলেও অধিকাংশ সময় কিন্তু এদের অপকর্মের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে রিপোর্টাররা। অফিস থেকেও এরমকই নির্দেশ দেওয়া থাকে। এখন দর্শক হিসেবে একজন কিন্তু জানতে চাইতেই পারেন নিজামীর স্বজনদের বক্তব্য। ৭১ যেমন জ্বলজ্বলে সত্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটও তো মিথ্যা না। তারচেয়েও বড় কথা, ধরেন এই যে হুম্মাম কাদের চৌধুরী যে তার বাপের মতোই বেয়াদব সেটা কি তার অঙ্গভঙ্গি আর বক্তব্য না শোনালে জানতে পারতাম আমরা? এই রাজাকারগুলো যে রক্তবীজের ঝাড় পুঁতে রেখে গেছে বা যাচ্ছে, তাদের সম্পর্কেও যে আমাদের সতর্ক আর টানটান থাকতে হবে, লড়াই এর মাঠ যে এখনও খালি নয় সেকথা জানতেও তো এদের দেখানো দরকার!

আমার পরিচিত এই দুজনের মতো আরও অনেকেরই অভিযোগ দেখি সাংবাদিকদের প্রতি। অ্যাজ ইফ, দর্শকদের রুচি আর দেখতে চাওয়ার চাহিদা পরিবর্তন করার দায়-দায়িত্ব শুধুই ঐটুকু জায়গায় জান-প্রাণ দিয়ে তথ্য জানানোর চেষ্টা করা সাংবাদিকদের। এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য। বিবৃতির পর বিবৃতি, তারপর জাতীয় পরিষদে নিন্দাপ্রস্তাব পাশ। আর তুরষ্কের কাহিনী তো দেখলেনই। এসবই কিন্তু সাংবাদিকরা শুধু যে পেশাদারিত্বের সাথে প্রকাশ করেছেন তাই নয়, দেশপ্রেম আর ইনটিগ্র্র্রিটির জায়গাতেও বহাল থেকেছেন। তবুও সরেনি অভিযোগের তীর।

কক্সবাজারে পাঁচ সাংবাদিককে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা জখম করেছে মেরে, নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে গলা কেটে হত্যা, আর নারায়ণগঞ্জের একজন শিক্ষককে কানে ধরিয়ে ওঠা-বসা করানো...সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব খবরের সাথে সাথেই সাংবাদিকদের একটু টক-ঝাল ঠিকই শুনিয়েছেন সবাই। এসব খবর নাকি মেইনস্ট্রিমে ঠিকঠাক আসেনি। আমি কোনো অজুহাত খাঁড়া করানোর চেষ্টা করবো না, তাতে এমন কিছু আসে-যাবেও না। শুধু একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, সীমাহীন বাধ্যবাধকতার মধ্যেই আমাদের সাংবাদিকতার বাতিখানি জ্বালিয়ে রাখতে হয়, এটুকুও যদি পারা না যেতো আসলে কিছুই করার ছিল না। আমরা এইসব বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়েই বড় বড় গালভরা বুলি নিয়ে পালন করি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে। আমি বলি কি, আপনার পুরো সমাজ পচে যাচ্ছে, আর আপনি আশা করবেন, সাংবাদিকরা হবেন সততার চরম পরকাষ্ঠা- এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। তারাও পার্ট অব সোসাইটি। অতএব, একটু সময় দিন আর সহায়তা করুন গণমাধ্যমকে, সবসময় অভিযোগের তীর কাজে না-ও লাগতে পারে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজ

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।