সামনে চলার পথ এখনই খুঁজে নিতে হবে


প্রকাশিত: ০৬:৩৮ এএম, ১৩ মে ২০১৬

মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রধান প্রধান আসামিদের বিচার ও শাস্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, গোলাম আযমসহ বয়োবৃদ্ধ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য জামায়াত-বিএনপি নেতা বিচারকালে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশ যথা সময়ে করতে পারেনি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল অপরাধীসহ তা সম্পূর্ণ করাও সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে, ফলে সেদিক থেকে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আমাদের বকেয়া কাজ। কিন্তু এর মধ্যে জাতি আরো বড় অপরাধের সম্মুখীন হয়েছে। এ ৪৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে এবং তাতে সবচেয়ে অবক্ষয় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।

অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, আজ অনেক বিজ্ঞজনও প্রশ্ন তোলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার কি? এরই আদলে কেউবা বলেন, একুশের চেতনাই বা কি? অসংখ্য নেতা-কর্মী-জনতার অবদানে-আত্মদানে বাংলাদেশ যে ভাবাদর্শ অর্জন করেছিল তা খুন হয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার চেয়ে কম বড় অপরাধ নয়, কম আফশোসের বিষয় নয়। অথচ এটি হারিয়েই তো জাতি আজ দিশাহীন- ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের তৎপরতার কাছে প্রায় অসহায়।

এ কারণে এবং এছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের উল্লাস কিংবা বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অতিরিক্ত প্রচারণার মানসিকতাকে পরিণত বুদ্ধি ও সুরুচির পরিচায়ক মনে করি না। এতো আইনি প্রক্রিয়ার নৈর্ব্যক্তিক অনিবার্য পরিণতি মাত্র, তা ছাপিয়ে একটি পক্ষের ভাবাবেগ প্রকাশের সেই আতিশয্য মোটেও কাম্য নয়। তারও চেয়ে বড় কথা, এতে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শে দেশগড়ার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা এবং যা করণীয় সেসব জরুরি বিষয় চাপা পড়ে যায়।

যে বাংলাদেশে নিজ গ্রামে গানের স্কুল খোলার অপরাধে একজন নির্বিবাদী জ্ঞানসাধক বাঁচতে পারেন না, বাউলতত্ত্বে আগ্রহী অধ্যাপককে প্রাণ দিতে হয়, যেখানে ক্রমেই জ্ঞানসাধনার মুক্ত বার্তাবরণ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে সেখানে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ আজ কতটা সংকটে রয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষ একে শ্লোগানের মধ্যে টিকিয়ে রেখে কীভাবে জাতির এবং দেশের জীবনে সত্য করে তুলবেন?

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার জাতির আরব্ধ কাজ, তা নিজ নিয়মে সম্পন্ন হোক। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাজ কি তাদের শাস্তি, চরম শাস্তি উদযাপন? আবারো বলব, এতে দেশের বাস্তবতা সম্পর্কে উপলব্ধি নেই, পরিণতি ও প্রজ্ঞার পরিচয় নেই।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে এদেশের মানুষ পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ধাপে ধাপে দুই দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে কয়েকটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। সেগুলো হলো অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উদার মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক চেতনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জনগণের অংশীদারিত্বসহ গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মাধ্যমে সুশাসন এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চাসমৃদ্ধ শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক সমাজ গঠন। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলেই এককাতারে শামিল হয়ে যুদ্ধ করেছে, ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছে এবং দেশ গড়ায় হাত লাগিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে প্রণীত সংবিধানে তাই রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হয়েছিল (মনে রাখা দরকার, সমাজের নয়), গণতন্ত্রের অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোষণা ছিল এবং সমাজতন্ত্রে আস্থা ব্যক্ত করা হয়েছিল।

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সনে এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ, আজ ৪৫ বছর ধরে তা কমতে কমতে এক-দশমাংশের নিচে নেমে গেছে। প্রশ্ন হল- কেন? কেউতো স্বেচ্ছায় চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগ করতে চায় না। তাদের উৎখাত হওয়ার জন্যে নানা ঘটনা ঘটছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বেড়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনও ক্রমেই বেড়েছে। সংখ্যাগুরু সমাজ এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ করেনি, রাষ্ট্রও তা যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। গত পঁচিশ বছর ধরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয়নি, সর্বত্র ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনের দখলদারি কায়েম হয়েছে। মানুষ ন্যায় বিচার-সুবিচার-দ্রুত বিচার পাচ্ছে না।

এবারে ইউপি নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কীভাবে গণতন্ত্রকেও গলাটিপে ধরেছি। স্বাধীন চিন্তা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার কারণে যেসব মানুষ খুন হয়েছেন সেসবের অপরাধীদের ধরতে বা বিচার শুরু করতেও পারছি না। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থামাতেও পারছি না। কুমিল্লার সোহাগ জাহান তনুর মত সংস্কৃতিমনা তরুণীর হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে শক্তিধরদের কাছে সাধারণ মানুষ কি অসহায়। দিনে দিনে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়ে আমাদের সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকারকে ব্যঙ্গ করছে আজ।

পদ্মাসেতু নিশ্চয় তৈরি হবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরেও নিশ্চয় আরো উড়ালপুল হবে, দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মানুষের বেতন-আয়ও বাড়বে। কিন্ত প্রশ্ন হল, সেসব কার জন্যে, হবে কোন বাংলাদেশে? সংস্কৃতি চর্চাহীন, জ্ঞান চর্চাহীন সে দেশটিই কি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম?

সমাজ কখনো ধর্মচর্চা বাদ দেয়নি, বরং আমাদের সমাজ চিরকালই ধর্মভীরু মানুষের দেশ। কিছু মানুষ শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, কিছু মানুষ মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-আদর্শের ওপর গুরুত্ব দিয়ে জীবন নির্মাণ করেন। সমাজে কেউ প্রথানুযায়ী নিয়মবদ্ধ জীবনে সমর্পিত থাকেন কেউ বা ভাবুক প্রকৃতির, সৃষ্টিশীলতায় জীবনে সার্থকতা পান। কেউ নিয়মশৃঙ্খলা মেনে আপন গতিতে জীবন কাটান, কেউবা গতি ভেঙে সমাজের সেবায় আনন্দ পান। মানুষের মধ্যকার স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য এবং সৃষ্টিশীলতা মানব সমাজকে প্রাণবন্ত করে, সার্থক করে।

বাঙালির সমাজ জীবনের এটাই হল শক্তির জায়গা। তা আজ অন্ধশক্তির বিকারের সামনে হুমকির মুখে পড়েছে। আজ বাংলাদেশে জরুরি হয়ে পড়েছে গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের মত সাংস্কৃতিক জাগরণ ও  সে ধারায় ব্যাপক কার্যক্রম যা পুষ্টি জোগাবে রাজনীতিতে, সমাজজীবনে। তাতে রাজনীতির যে বিমানবীকরণ হচ্ছে তাও বন্ধ হবে। এর জন্যে আমাদের তাকাতে হবে তরুণ সমাজের দিকে, বিশেষভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিকে। আমরা জানি না, অথবা প্রায় জানি- আজকের নষ্ট ছাত্র রাজনীতির পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়।

ইতিহাসে সবসময় একই পদ্ধতিতে কাজ হয় না। যদি সংগঠনের বাইরে ছাত্র-তরুণরা দল গড়তে পারে এবং তাতে সাহিত্য চর্চা, শিল্পকলা চর্চা, খেলাধুলা, পাঠচক্র আয়োজন, সেবামূলক কাজ শুরু করতে পারে তবে বর্তমান স্থবিরতা কাটতে থাকবে। ভাবনার জগৎ খুলে দিতে হবে, চিন্তার পরিসর বাড়াতে হবে, সুস্থ বিনোদনের জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। এর সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার আনন্দ যুক্ত হলে সমাজের বৈনাশিক অবক্ষয় ও চিন্তার অন্ধত্ব ঘুচে যাবে।

একজন আলবদর বা রাজাকারের বিচার বা শাস্তি ব্যক্তির কৃত অপরাধের শাস্তির বেশি কিছু নয়। তাতে আমাদের হারানো চেতনা ফিরে আসবে না। অথচ এটা হারানো আমাদের চলবে না। তাতে যে মুক্তিযুদ্ধই হারিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতা অর্থ হারিয়ে ফেললে এত সংগ্রাম এত আত্মদানের কি তাৎপর্য থাকে? তাতে বরং একাত্তরের হানাদার ও তাদের দোসরদের সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভবিষ্যতের কথা ভেবে চেতনার এই বিপন্ন বর্তমানে আমাদের আবারো একাত্তরের ভাবাদর্শে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার জাতিকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। পথ এখনও অনেক বাকি।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ

আরএস/এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।