গণমাধ্যম নীতিমালা আইন ও কমিশন


প্রকাশিত: ০৪:৫৫ এএম, ১০ মে ২০১৬

শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর  গণমাধ্যম প্রসঙ্গটি যেভাবে আলোচিত হয়েছে সেটি সম্ভবত এর আগে আর কখনও হয়নি। আমার নিজের ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে এই সময়ে আমাদের গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে এবং গণমাধ্যম তার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পেরেছে। এই সরকারের একটি প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে গণমাধ্যমকে কেন্দ্র করে আইন, নীতিমালা ও কমিশন গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এরই মাঝে সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সরকার অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সম্প্রচার নীতিমালার আলোকে সম্প্রচার আইনের খসড়াও তৈরি করেছে। সর্বশেষ গত ৫ মে প্রেস ইন্সটিটিউটে এই খসড়া আইনটি নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী উন্মুক্ত আলোচনা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী, তথ্য উপদেষ্টা, বর্ষীয়ান গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ অনেকেই সেই আলোচনায় অংশ নেন।

ব্যারিস্টার তানজিব উল আলমের নেতৃত্বাধীন একটি খসড়া কমিটি যার সাথে আমিও যুক্ত ছিলাম, সেই উপ-কমিটি আইনের খসড়াটি প্রস্তুত করে। এই খসড়া আইনটি প্রস্তুত করার ভিত্তিটি হচ্ছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। সেই নীতিমালাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত খসড়া ও চূড়ান্ত একটি বিষয়। অাইনের খসড়া নিয়ে আলোচনায় ছোটখাটো অনেক প্রসঙ্গ থাকলেও দুটি বড় প্রসঙ্গ ছিলো আলোচনার কেন্দ্রে। প্রথম যে প্রসঙ্গটি নিয়ে উত্তেজনাকর আলোচনা হয় সেটি ছিলো লাইসেন্সিংসহ সকল বিষয়ে কমিশন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা পাবে নাকি লাইসেন্সিং-এর ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রাখা হবে। আমরা যখন আইনের খসড়া তৈরি করি তখন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। লাইসেন্সিংও কমিশনের একক নেতৃত্বে দেয়া হবে বলে সেই খসড়ায় উল্লেখ করা ছিলো। পরে মন্ত্রণালয় একটু সংশোধন করে তাতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বিষয়টি যুক্ত করে। আলোচনায় অংশীজন এর বিরোধিতা করেন। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি আমি উত্থাপন করি। প্রশ্নটি মৌলিক। সম্প্রচার কমিশন ও সম্প্রচার আইনে অনলাইন গণমাধ্যমকে কেমন করে একীভূত করা হবে। আজকের আলোচনায় আমি প্রধানত দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি নিয়েই আলোচনা করতে চাই। কারণ আমরা কমিশনের স্বাধীনতার প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপের পক্ষেই নই। তাই এটি আলোচনার বিষয় নয়। কমিশনকে সকল বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেই হবে।

২০১৪ সালের আগস্টের ৬ তারিখে প্রজ্ঞাপন জারি করার আগে মন্ত্রিসভা খসড়া অনুমোদনের পর থেকেই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পরও সেই আলোচনা অব্যাহত ছিলো।  সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট ১৪ ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে আর্টিক্যাল ১৯ সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন মিলে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যেখান থেকে একটি অভিন্ন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ওঠে। আমি দাবিটি উত্থাপন করার পর বিএফইউজে নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান এই দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। এরপর দেশ টিভিতে আমি একই দাবির পুনরুল্লেখ করি। তখনও আলোচকগণ আমার সাথে একমত পোষণ করেন। তারপর বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটে এক সেমিনারে আমি একই বিষয়ে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করি যাতে সকল গণমাধ্যমের জন্য একটি আইন, একটি নীতিমালা, একটি কমিশন ও একটি ওয়েজবোর্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

এতোদিন পর গত ৫ মে সেই আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন হয়েছে তা হলো তুমুল আলোচিত সম্প্রচার নীতিমালা গেজেট হয়ে গেছে। এটি নিয়ে এখন আর আলোচনা করে কোন ফায়দা নাই। তার আলোকে আইন হচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালাও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আমরা যখন আইনটির চূড়ান্ত খসড়া করে ফেলি তখন এর সাথে অনলাইন গণমাধ্যমকে যুক্ত করা হয়। বলা হয় যে, সম্প্রচার ও অনলাইন বিষয়ে দুটি আলাদা কমিশন করা যাবে না, একটি কমিশনই করতে হবে। অনলাইন নীতিমালায় আমরা আলাদা কমিশনের কথা বলেছিলাম। এজন্য আলাদা আইনও করতে হতো। কিন্তু সরকার যেহেতু একটি কমিশন করার কথা ভাবছে সেহেতু পুরো ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়েছে। সম্ভবত এখন সময় হয়েছে বিষয়টিকে আবার নতুন করে দেখার। এই নিবন্ধে আমি নীতিমালা ও আইনের বিষয়বস্তুর চাইতে সম্প্রচার ও  অনলাইন গণমাধ্যম বিষয় দুটিকে সমন্বিত করার উপায় নিয়ে বেশি আলোচনা করতে চাই।

আমি আমার নিজের অবস্থান এভাবে সুদৃঢ় করে বলতে চাই যে,  প্রকৃতপক্ষে আজকের দিনে সম্প্রচার নীতিমালা বা অনলাইন নীতিমালা কিংবা সংবাদপত্র নীতিমালা নামে, চলচ্চিত্র নীতিমালা ইত্যাদি আলাদা আলাদা কয়েকটি (অন্তত চারটি) নীতিমালা প্রণয়ন করার কোনো যৌক্তিক কারণ নাই। আজকের দিনে সিনেমা হল, কাগজ, টিভি বা অনলাইন পোর্টাল বলতে আলাদা আলাদা কিছু নাই। এখন কাগজের পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থাকে। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের থাকে ওয়েবসাইট বা অনলাইন স্ট্রিমিং। অনলাইনতো সংবাদপত্র আর সম্প্রচারের সম্মিলিত রূপ। সিনেমা এখন সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত হয় ইউটিউবে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সিনেমা ওরফে ভিডিওর সবচেয়ে বড় প্লাটফরম। অন্যদিকে আইপি টিভি-আইপি রেডিও জাতীয় প্রযুক্তির ফলে মোবাইল ফোন থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত ডিজিটাল প্রযুক্তির যে দাপট তাতে কোনটাকে কোনটা থেকে আলাদা করা যাবে তা বলা কঠিন।

এখন ইচ্ছে করলে যে কেউ সরকারের সম্প্রচারের লাইসেন্স ছাড়া ইন্টারনেট প্রটোকলকে ব্যবহার করে রেডিও বা টিভি সম্প্রচার করতে পারেন। বস্তুত এটি বৈধ না অবৈধ সেটিও কোনো আইনে স্পষ্ট করে বলা নাই। আমরা মনে করি অবৈধ না হলেই সেটি বৈধ। অনলাইন গণমাধ্যম এখন এভাবেই চলছে। কোনো নীতিমালা এর জন্য নেই। কোনো আইন বা বিধি বিধান এর জন্য নেই। কোথাও এর উল্লেখও নাই। ফলে কোনো একটি অনলাইন গণমাধ্যম কারও কাছ থেকে কোনো লাইসেন্স না নিয়েই একই সাথে একটি কাগজের পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনের সম্মিলিত প্রকাশনা ও প্রচারের কাজ করে যেতে পারে।  ভাবতে হবে যে, সেই গণমাধ্যমটির জন্য কোন নীতিমালা প্রযোজ্য হবে?

অন্যদিকে মিডিয়াতো কেবল কাগজ, টেলিভিশন, বেতার বা পোর্টালের মাঝে সীমিত  নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বড় ধরনের মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। ব্লগ নামক ইন্টারনেটভিত্তিক একটি কর্মকাণ্ড অন্য অনেক মাধ্যমের চাইতে শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি গণজাগরণ মঞ্চের উদ্ভব ও বিকাশের দিকে তাকাই তবে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগের ক্ষমতার বিষয়টি আঁচ করতে পারবো। অন্যদিকে বাঁশের কেল্লা, রামুর ঘটনা ইত্যাদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে তথ্যপ্রযুক্তি কতোটা শক্তিশালী মিডিয়ার জন্ম দিয়ে চলেছে। আমরা হয়তো এখনও আন্দাজই করতে পারছি না যে, ইন্টারনেট দুনিয়াটাকে কতোটা কেমন বদলে দিচ্ছে। ফলে একদিকে মিডিয়া বা গণমাধ্যমের সংজ্ঞা যেমন বদলাতে হবে তেমনি সনাতনী মানসিকতাকেও পাল্টাতে হবে। ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত মানসিকতা ছাড়া এই যুগের কিছুই সামনে নেয়া যাবে না।

সেই কারণেই বহুদিন ধরেই আমি একটি জাতীয় গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলে আসছি। আমি আবার বলতে চাই যে, সম্প্রচার ও অনলাইন এই দুটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কমিটিতেই আমি যুক্ত-তবুও আমি সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে।  একই সাথে আমি এটি মনে করি যে, প্রচলিত পত্রিকার ডিক্লারেশন পদ্ধতি, প্রেসের ডিক্লারেশন, টিভি-বেতারের লাইসেন্স, অনলাইন পোর্টালের লাইসেন্স, আইপি টিভি-আইপি রেডিও, কমিউনিটি রেডিও, ব্লগ বা অন্যসব  ডিজিটাল মাধ্যমের অনুমতি দেবার জন্য একটি নীতিমালা ও একটি কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। এখন ডিসি সাহেবরা কেন পত্রিকার ডিক্লারেশন দেবেন, সেটি আমি বুঝি না।

ইংরেজ আমলে ব্রিটিশরা তাদের শাসন পাকাপোক্ত করে প্রকাশ মাধ্যমকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ব্যবস্থা চালু করেছিলো, সেটি পাকিস্তানও অব্যাহত রাখে। কিন্তু একই ব্যবস্থা এখনও কেন চালু রাখতে হবে সেটি আমি বুঝি না। ডিসিদের সাথে পত্রিকার ডিক্লারেশন কিভাবে যুক্ত সেটি আমি বুঝতে অক্ষম। একই সাথে তারা ছাপাখানার ডিক্লারেশন কেন দেবেন তাও আমি জানি না। এখন কি আমাদের বোঝা উচিত নয় যে, প্রযুক্তি ছাপাখানাকে এখন আর শীশার হরফের ছাঁচে রেখে দেয়নি। বরং এখন আমাকে ছাপাখানার  জন্য  অপেক্ষা করতে হয় না। লেসার প্রিন্টার দিয়ে যখন আমি যা খুশি, যেখানে খুশি ছাপতে পারি তখন ছাপাখানার কেন ডিক্লারেশন লাগবে সেটাও আমি জানি না। ছাপাখানাতো এখন আমার পকেটে। এমনকি আমি ঘরে বসে অফিসের প্রিন্টারে বা দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে প্রিন্ট করার ক্ষমতা রাখি। এখানে ডিসি সাহেবরা কি করতে পারেন?

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে গণমাধ্যমকে জনস্বার্থ রক্ষা করতে হয়। তারা জনগণের জন্য কাজ করে এবং জনগণের জন্য উপাত্ত সরবরাহ করে। এইসব গণমাধ্যম যা করতে পারে তা সব প্রযুক্তিতেই করতে পারা উচিত। যা করতে পারে না তা কোনো প্রযুক্তিতেই করতে পারা উচিত নয়। এটি এমন নয় যে, আমি কাগজের পত্রিকায় ভুল তথ্য দিতে পারবো না কিন্তু ইন্টারনেটে দিতে পারবো। আবার কাগজের পত্রিকার সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজবোর্ড থাকবে কিন্তু সম্প্রচার বা-অনলাইনের জন্য থাকবে না, সেটি কেন তাও বুঝি না। প্রেস কাউন্সিল কি ভূমিকা পালন করে সেটিও আমি বুঝতে অক্ষম।

আমি মনে করি, সরকার হযবরল যুগের অবসান ঘটিয়ে ডিজিটাল যুগের জন্য একটি গণমাধ্যম নীতিমালা ও কমিশন গড়ে তুলবে এবং তারই আলোকে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমন্বয় করবে। প্রতিটি প্রযুক্তির জন্য আলাদা ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা থাকতে পারে-এমনকি প্রযুক্তি নির্ভর নির্দেশনাও থাকতে পারে-কিন্তু নীতিমালার জঙ্গল তৈরি করা ঠিক হবেনা। প্রতিটি প্রযুক্তির জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করাও ঠিক হবেনা। একটি কমিশনই সকল বিষয়ে দেখাশোনা করতে পারে। কমিশনের মধ্য থেকে বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য আলাদা আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব ভিন্ন থাকলেও ওয়েজবোর্ড নামক প্রতিষ্ঠানটি আলাদা হতে পারেনা। বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য বেতন কাঠামো আলাদা হবে কিনা সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে-কিন্তু কাউকে ওয়েজবোর্ডের আওতায় রেখে অন্যকে বাইরে রাখা ঠিক হবে না।

সার্বিকভাবে  এই অনুরোধটি আমি করতে চাই যে, সম্প্রচার নীতিমালা ও অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার সাথে কাগজের পত্রিকাগুলোর জন্য একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে সবগুলোকে সমন্বিত করে সকল গণমাধ্যমের জন্যই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। সেই নীতিমালার আলোকে একটি গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হোক এবং ওয়েজবোর্ড সকল গণমাধ্যমের জন্য সম্প্রসারিত করা হোক। প্রেস কাউন্সিলকে গণমাধ্যম কমিশনে একীভূত করা হোক। এজন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করলেই হবে। গণমাধ্যম নীতিমালাকে ঘাটে ঘাটে না ভিড়িযে কাজের কাজটি করার জন্য অনুরোধ করছি। সুখবরটি হচ্ছে যে, অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার যে খসড়াটি আমরা তৈরি করেছি সেটিকে সামান্য সংশোধন করেই একটি অভিন্ন গণমাধ্যম নীতিমালায় পরিণত করা যায়। এর ফলে গণমাধ্যম বিষয়ক বিভ্রান্তি খুব সহজেই দূর হতে পারে। বারবার নীতিমালা তৈরি করার ঝামেলার পাশাপাশি নতুন নতুন আইন, নতুন নতুন কমিশন গঠন করার সংকটও কেটে যাবে। যাহোক সরকার সবটা মিলিয়ে এমন একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেবে কিনা জানিনা, বরং প্রস্তাবিত খসড়া সম্প্রচার আইনকে গণমাধ্যম নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে দুটি নীতিমালার বিষয়গুলোকে সমন্বিত করতে হলে কি করতে হবে সেটি আলোচনা করা যেতে পরে।

আমি আগেই বলেছি যে প্রচণ্ড আগ্রহ ও দাবি থাকার পরও কাগজ, সম্প্রচার ও অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা, অভিন্ন আইন বা অভিন্ন কমিশন হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এরই মাঝে কাগজের গণমাধ্যমকে আলাদা করেই রাখা হয়েছে। কেউ সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন না। কাগজরে গণমাধ্যমের অংশীজন বা সরকার কেউ এটি নিয়ে আলোচনাই করতে চান না। ১৯৭৪ সালের প্রেস এন্ড পাবলিকেশন আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বা অন্যান্য প্রচলিত আইনের খড়্গ থাকার পরও কেউ চায় না কাগজের গণমাধ্যমের কোনো নীতিমালা হোক। যেহেতু সম্প্রচার নীতিমালার পর অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালাও চূড়ান্ত স্তরে আছে এবং যেহেতু একটি আইন ও একটি কমিশন দিয়ে দুটি খাতকে সমন্বিত করার চেষ্টা করা  হচ্ছে সেহেতু বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

আমরা খসড়া আইনটির আলোকে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারি।
১) এখন সম্প্রচার আইনকে যেভাবে অনলাইন গণমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে তাতে আইনের নাম সম্প্রচার ও অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে নামকরণ করতে।  কমিশনের নামও তাই করতে হবে। সম্প্রচার আইনের ভেতরে অনলাইনের প্রসঙ্গগুলো যুক্ত করতে হবে এবং আইনের মূল কাঠামো ঠিক রেখে হলেও প্রচুর পরিমার্জনা করতে হবে।

২) খসড়া সম্প্রচার আইনে অনলাইন গণমাধ্যমের সংজ্ঞাই নেই। ফলে আইনে এর একটি সংজ্ঞা যোগ করা দরকার। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার আলোকে এই সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করতে হবে। আমি মনে করি সম্প্রচার ও সম্প্রচার কার্যক্রমসহ আরও বেশ কিছু সংজ্ঞা আছে যা আরও স্পষ্ট করে সহজ বাংলায় প্রকাশ করতে হবে। সংজ্ঞায় ইন্টারনেট, নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল কনটেন্টস, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, আইপি টিভি, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ, ওয়েবসাইট, ই-মেইল ইত্যাদির সংজ্ঞাও থাকতে হবে।

৩) ৪ নং ধারায় কমিশনের নাম পরিবর্তন করতে হবে। এটি কেবলমাত্র সম্প্রচার কমিশন হতে পারে না। কোনোভাবেই সম্প্রচার কমিশন  অনলাইন গণমাধ্যমকে সমন্বয় করতে পারবে না।

৪) ১২ নং ধারায় কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর বিবরণে অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য নির্দেশিকা প্রস্তুত করার কথা থাকতে হবে। খ উপধারায় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা যুক্ত হতে হবে। ঘ) উপধারায় অনলাইন গণমাধ্যম অফিস শব্দ যোগ করতে হবে। এমনি করে যেখানে যেখানে সম্প্রচার নীতিমালা কথাটি আছে।

৫) ১৯ ধারায় লাইসেন্সের বিষয়টিতে কেবলমাত্র আইপি টিভি রয়েছে। অনলাইন গণমাধ্যমের আর কোনো বিষয় এতে নেই। নিউজপোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম,ব্লগ বা অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট করে লাইসেন্সের বিষয়, লাইসেন্স না থাকলে তার শাস্তির বিষয় ইত্যাদি যুক্ত করতে হবে।

পুরো খসড়াটি পড়ে আমার মনে হয়েছে এক কাজের জন্য প্রণীত আইনকে খুব সহজে অন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় না। অনেক চেষ্টা করে খসড়া আইনটিতে অনলাইন গণমাধ্যমের বিষয়গুলোকে যুক্ত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। কামনা করবো এইসব বিষয়ে সরকার বিদ্যমান অবস্থার পাশাপাশি ডিজিটাল যুগের মিডিয়ার রূপান্তরটি মাথায় রেখে কাজ করবেন। অন্যথায় আমরা জগাখিচুরিতেই থেকে যাব।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিষ্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।