আমরা কি প্রতিবাদ করার আগ্রহও হারিয়ে ফেলছি?


প্রকাশিত: ০৩:৩৯ এএম, ০৯ মে ২০১৬

গত ৫ মে পত্রিকাগুলোতে এসেছে, হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক এখন সবচেয়ে ভালো। এটা বোঝার জন্য এরিস্টেটল হওয়া লাগে না। কিন্তু আমারে কেউ বলুন তো, হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক খারাপ ছিল কবে?

আওয়ামী লীগের হেফাজত দিয়ে জামায়াত ঘায়েল করার একধরনের সিদ্ধান্তের কথা আকাশে-বাতাসে ভাসে। সেসব একপাশে সরিয়ে রেখে আমি ভাবি জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের কথা। জুলহাজ যেদিন হত্যাকান্ডের শিকার হলেন তার পরদিন একজন ক্রাইম রিপোর্টারের সাথে কথা হলো। তিনি মুখটিপে হাসছিলেন। বললেন, আপা, বুঝছেন সমকামিতা নিয়ে কাজ করতো না শুধু নিজেও তাইছিল। সঙ্গের যে ছেলেটি মারা গেল সেও পার্টনার।

না জনাব ক্রাইম রিপোর্টার এর বেশি কিছু বলেনওনি, শ্লেষও করেননি। কিন্তু আমার হলো চোখের ভাষা পড়ার অভ্যাস। আমি কিন্তু তার মুখটিপে হাসা আর কথা বলার ভঙ্গিতে বুঝে যাই, সস পেয়ে গেছেন জনাব রিপোর্টার।

একটা অদ্ভুত ঊনতারবোধ আমাকে ছেয়ে ধরে। আচ্ছা আমাদের সমাজটা কি সবসময়ই এরকম রেসিস্ট ছিল? আমি একসময় বিনোদন সাংবাদিকতা করেছি। কতশত নাচের শিল্পীর সাথে পরিচয় ছিল। নাচের ছেলে শিল্পীদের অধিকাংশই একটু মেয়েদের মতো করে কথা বলা, মেয়েদের মতো আচরণ করার অভ্যাস ছিল। এর কি কারণ তা অনুসন্ধান করতে হবে এমন ভাবনা আসেনি। সবচেয়ে বড়কথা, এই ছেলেদের সাথে নাচ করা কোনো মেয়ে অর্থাৎ তাদের সহশিল্পীদের আমি দেখিনি তাদের সাথে অসম্মানজনক অথবা অসহজ কোনো আচরণ করতে।

বরং উল্টোটা দেখেছি। একটু বেশিই সমীহ করতে দেখেছি তাদের। কারণ ঐ মেয়েদের মতো করে কথা বলা বা মেয়েলী আচরণ করা ছেলেটিই হয়তো নৃত্যশিল্পী মেয়েদের নাচের মুদ্রা তুলে দিতো ঠিকঠাক, শিল্পটাতে দক্ষতা অর্জন করতে তাঁরাই হয়তো সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতেন। (আর মানুষের বিভিন্ন ধরনের আচরণের জন্য মেয়েলী, পুরুষালী এইশব্দগুলোও কিন্তু যথেষ্ট জেন্ডারসেনসেটিভ।) আসলে, শ্রদ্ধাবোধটাতো আসে ভেতর থেকে। এই ছেলেগুলোর সাথে সহজভাবে মেশা এবং কাজের সম্পর্ক রাখার কারণেই হয়তো তারা কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাত নাড়ে তা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায় না নৃত্যশিল্পীদের কাছে।

কিন্তু ওই নৃত্যশিল্পীরা সমাজের কত পার্সেন্ট? মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করার প্র্যাকটিসটাকি আমাদের দেশে আদৌ আছে? এখন যদি সমকামী কোনো নারী বা পুরুষ নৃত্যশিল্পী বা এরকম কিছুই না হন তার কি একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাওয়ার অধিকার নেই?

জুলহাজ হত্যাকান্ডও বঙ্গদেশের লাশের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইউএস দূতাবাসে কাজ করতেন বলে হয়তো একটু বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বিষয়টি। নিশা বিসওয়াল সফর করে গেছেন ইতোমধ্যে। আমাদের সরকার এরমধ্যে কিছুতেই স্বীকার করবেন না যে দেশে আইএস আছে। ভালো কথা, করবেন না। করলে পশ্চিমাদের হামলে পড়ার আশংকার কথা এর কারণ  হিসেবে অলিখিতভাবে বলে থাকেন। কিন্তু এর সমাধানটা কি?

তবে এসব নয়। আমি বলতে চাইছি কি, সমাধানটা সরকারের তরফ থেকে যতটা ঠিক ততটাই বোধ করি আসতে হবে আমাদের মানে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও। রেজাউল করিম সিদ্দীকির মৃত্যুর প্রতিবাদে কজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহবাগে। সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক মানুষ। সেই ছবিটাই আমার চোখে লেগে আছে।

আমরা সম্ভবত প্রতিবাদ করার ইচ্ছে আর আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো বিচার হয় না বলেই। কিন্তু একটা হত্যাকান্ড ঘটার পর তার নামের আগে সমকামী জুড়ে দেয়ার মানসিকতা যতদিন না আমরা ত্যাগ করতে পারবো, যতদিন না শ্লেষের হাসি হাসাটা ছাড়তে পারবো ততদিন পর্যন্ত সম্ভবত: এই গালভরা তথাকথিত সেক্যুলার সরকারের প্রশাসনও নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের নিতে বলবেন।

আমাদের এই সব জিডিপি গ্রোথের মোহময়ী রূপের ধাক্কা কাটিয়ে মানসিক পরিবর্তনটা ভেতর থেকে না আনলে জানিনা দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আর এইযে দর্জি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা থেকে শুরু করে গানের শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বইয়ের প্রকাশকের লাশের মিছিল- এই মিছিল না থামানো গেলে, সিরিয়া, লিবিয়া বা মিশরে বা এই জাতীয় দেশগুলোর অবস্থা মাথায় রাখেন প্লিজ- সরকার বাহাদুর। আমাদের বিকল্প নাই, কিন্তু অজনপ্রিয়তা যদি আকাশে গিয়ে ঠেকে, তাহলে কে জানে আইএসকেই হয়তো মাথায় নিয়ে নাচবে আমাদের বোকা আর দুঃখী বাংলার জনগণ।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজ

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।