চাই স্থায়ী ট্রাইব্যুনাল


প্রকাশিত: ০২:১০ এএম, ০৮ মে ২০১৬

মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছে আবারো। এবং এবারের জন ছোটখাট কেউ নন, স্বয়ং জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী। বৃহষ্পতিবার সর্বোচ্চ আদালতে নিজামীর রিভিউ আবদেন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর তার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া এখন কেবলই সময়ের আনুষ্ঠানিকতা।

কিন্তু শুরু থেকে সরকারকে তার শাসনকার্যে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে এই একটি কাজ করতে গিয়েই। দেশের ভেতর এক চরম সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে জামায়াত-বিএনপি। অন্যদিকে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নামানোর চেষ্টা করেছে। আর তাই আমরা দেখি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলে পাকিস্তান। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধামন্ত্রীকে ফোন করে বিচার বন্ধ করার সুপারিশ করেন।

কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের এই বিচার নিয়ে প্রশ্ন করছে। পাকিস্তান করছে, তার প্রেক্ষাপট আছে। কিন্তু অন্যান্য দেশ কেন বিরোধিতা করছে? তবে কি আমাদের যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় সমস্যা রয়েছে?    
    
একটি ভয়ংকর বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের জনগণ অসীম সাহসে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা এনেছে। সাধারণ যুদ্ধে যা না হয় তার চেয়ে অনেক বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আমাদের মাটিতে। পাকিস্তানি বাহিনী করেছে, কিন্তু কম করেনি তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগের নেতাকর্মিরা।  

এখানে যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে, টার্গেট করে করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মা-বোন- সেসব অনেকটাই অজানা রয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। আর তাই এমন করে বিরোধিতা আসছে নানা স্তর থেকে।

এখানে হঠাৎ করে গণহত্যা শুরু হয়নি। অনেক সময় বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশ গুলি চালায়। তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যা করেছে সে জন্য অনেক দিনের প্রস্তুতি ছিল। আর হত্যাকাণ্ড চলে দেশের সর্বত্র, দিনের পর দিন। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে থেকে তাদের চেয়েও নিষ্ঠুরতম অপরাধ করেছে নিজামীরা।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চার দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ এর নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী ২০১০ থেকে বিচার কাজ শুরু করে। ইতোমধ্যেই কয়েকজনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে।

অন্যায়ের যারা শিকার হয়েছেন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ন্যায়বিচার মিলবেই। সাড়ে চার দশক আগে যেসব নারী লাঞ্ছিত-ধর্ষিত হয়েছেন, অনেকেই তাদের যন্ত্রণার কথা বলতে পারেননি। তাদের অনেকে আমাদের মাঝে নেই। অপরাধীদের একটি অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্য ছিল। বাংলাদেশে তাদের সহযোগী ছিল। তাদের অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।

পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝতে হবে বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকার পার্থক্য রয়েছে। এখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভিন্ন। তাছাড়া উন্নত বিশ্বের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের এ অঞ্চলের প্রতি মনোযোগ কম। তারা আর্মেনিয়া, সার্বিয়া, রুয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে যতটা সোচ্চার- বাংলাদেশ নিয়ে ততটা নয়।  

রাজনৈতিকভাবে যেমন, তেমনি দেশীয় আইনে এবং দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী, প্রশাসনিক বিভাগ ও বিচারকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু তাদের সামনে ছিল নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলা থেকে আরম্ভ করে চলমান কম্বোডিয়ার মানবতাবিরোধীদের বিচারের ইতিহাস ও কার্যক্রম; এসব বিচারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়সমূহ। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখেছেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বিশাল অভিজ্ঞতার আলোকে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় প্রদান করছেন।

নুরেমবার্গ থেকে আরম্ভ করে কম্বোডিয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অপরাধে ঘটনার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ব্যবধানে বিচার একমাত্র বাংলাদেশেই আরম্ভ হয়েছে। এই বিচার  প্রমাণ করেছে দেশের জনগণ ও সরকার যদি চায় অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব।

নিজামীর বিচারের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের একটি পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। ফাঁসি না হলেও অপরাধী প্রমাণিত হয়ে জেলে মারা গেছে রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজম। তার প্রধান শিষ্য নিজামী এখন তার সাথে মিলিত হওয়ার পথে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো কুৎসিত ও ভয়ংকর অপরাধীর ফাঁসি হবে এটা হয়তো কেনদিন কেউ ভাবেনি।
 
বড় বড় এসব পরিচিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে। কিন্তু অপরাধী শুধু তারা নয়, আছে অসংখ্য আরো। তাই এই বিচার যাতে অব্যাহত থাকে এখনই প্রয়োজন আইন প্রণয়ন করে অস্থায়ী ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী ট্রাইব্যুনালে রূপ দেয়া। আরও প্রয়োজন বিচার বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র, সহিংসতা ও অন্তর্ঘাত প্রতিহতকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেয়া। ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাত দেশের ভেতর মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে এবং দেশের বাইরে করতে হবে সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।

সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে। একাত্তরে যারা স্বজন হারিয়েছে তারা তাদের সন্তুষ্টির কথা জানাচ্ছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে আরো সক্রিয়ভাবে মাঠে নামতে হবে সামনের দিনগুলোতে। দেশে চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে মনে রাখতে হবে তার কারণ আর কিছুই নয়, খুনিদের একমাত্র লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করা। তাই আরেকবার একটি জাগরণ প্রয়োজন। আর সেই জাগরণের ডাক দিতে পারে আওয়ামী লীগই।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।