কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে
আমাদের প্রতিটি কর্ম আল্লাহপাকের কাছে লিপিবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘আকাশ সমূহে এবং পৃথিবীতে যা আছে সবই আল্লাহর। আর তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা প্রকাশ কর বা তা গোপন কর আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে এর হিসাব নিবেন। অতএব, তিনি যাকে চাইবেন ক্ষমা করবেন এবং যাকে চাইবেন আজাব দিবেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত: ২৮৪)।
এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মানুষের প্রত্যেক কাজেরই হিসাব দিতে হবে, তা যতই গোপন হোক কিংবা প্রকাশ্য আর এর জন্য পুরস্কার, শাস্তি বা ক্ষমা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পেতেই হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘যে সৎকর্ম করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দকর্ম করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের প্রতি কোনো জুলুম করেন না।’ (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত: ৪৬)
রোজ হাশরে আল্লাহতায়ালা মানুষের পাপ-পুণ্যের ফয়সালা করবেন এবং যার যার দুনিয়ার আমল-আখলাক কর্মফল অনুযায়ী নিখুঁত নিক্তিতে বিচার করবেন। যারা অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি ও অসৎকর্মে নিজকে নিয়োজিত রাখবে এবং পাপাচারে লিপ্ত থাকবে, প্রতিফলস্বরূপ তিনি তাদের কঠিনতম শাস্তির ভয়াবহ কষ্টে নিপতিত রাখবেন। আর যারা সৎকর্মের মধ্যে নিজকে সমর্পণ করবে এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুযায়ী ইহকালীন জীবন অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাদের সুখ-শান্তিময় বেহেশত প্রদান করবেন। শুধু তাই নয়, সেসব নেক আমলকারীকে সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করবেন।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আছে নিয়ামতে ভরা জান্নাত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ৮-৯)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, আজ কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।’ (সুরা আল-মুমিন, আয়াত: ১৭)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এ জন্য যে আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।’ (সুরা আল আহকাফ, আয়াত: ১৯)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সুরা আজ-জিলজাল, আয়াত: ৭-৮)
এ জন্য মানবজাতিকে অপকর্ম প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে নবি করিম (সা.) সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে, যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে, যদি সে এতেও অপারগ হয়, তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
অপর এক স্থানে হজরত আলি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘দুনিয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছে আর আখিরাত সম্মুখে আসছে আর এদের প্রত্যেকটির সন্তানাদি রয়েছে। তবে তোমরা আখেরাতের সন্তান হও, দুনিয়ার সন্তান হয়ো না। কেননা এখন আমলের সময়, এখানে কোনো হিসেব নেই, আর আগামীকল হিসাব নিকাশ হবে, সেখানে আমল করার কোনো সুযোগ নেই’ (বুখারি)।
আমরা যদি ভাবি যে, এই দুনিয়া হচ্ছে আনন্দ-ফূর্তির জায়গা, যখন যা ইচ্ছে করবো, আমাকে কে ধরবে? তবে একটি কথা আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আর তা হচ্ছে, এই দুনিয়া এক পরীক্ষা কেন্দ্র। আমরা সবাই পরীক্ষা দিচ্ছি, যে ভালো পরীক্ষা দিবে, সে ভালো ফল লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। সেদিন কেউ বলতে পারবে না যে, হায়! আমি যদি আবার দুনিয়াতে যেতে পারতাম তাহলে ভালো কাজ করে আসতাম। আমরা যা কিছুই করি না কেন আল্লাহ তা জানেন ও দেখেন।
আল্লাহতায়ালার সামনে আমাদেরকে উপস্থিত হতেই হবে এবং প্রত্যেক কর্মের হিসেব দিতে হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তারা সবাই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। তখন দুর্বল লোকরা অহংকারীদেরকে বলবে, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। অতএব, তোমরা আমাদের আযাবের কিছুটাও কি দূর করতে পার? তারা বলবে, আল্লাহ যদি আমাদেরকে হেদায়াত দিতেন, তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে হেদায়াত দিতাম। আমাদের জন্য এখন বিলাপ করা বা ধৈর্য ধারণ করা উভয়ই সমান। রক্ষা পাওয়ার কোনো পথ আমাদের নেই’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ২১)।
আমাদেরকে যেদিন আল্লাহপাকের সামনে উপস্থিত করা হবে সেদিন কেউ কারো বোঝা বহন করার সুযোগ পাবে না। যার যার হিসাব তাকেই দিতে হবে এবং আল্লাহপাক চাইলে কাউকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন।
যেভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত সাফওয়ান ইবনে মুহরাব (রা.) বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হজরত ইবনে ওমর (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ ও ইমানদার বান্দার মধ্যকার গোপন আলোচনা সম্পর্কে হজরত নবি করিম (সা.)-কে আপনি কীভাবে বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি তার রবের নিকটবর্তী হবে, এমন কি রব তার কুদরতি হাত সেই বান্দার ওপর রেখে দু’বার বলবেন, তুমি (দুনিয়ায়) অমুক অমুক কাজ করেছিলে। সে বলবে, জি হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি এমন কাজ করেছিলে? সে বলবে, জি হ্যাঁ। এভাবে তার নিকট হতে এর স্বীকৃতি আদায় করা হবে, তারপর বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার গুনাহ গোপন করে রেখেছি। আজ আমি তা মাফ করে দিচ্ছি’ (বুখারি, কিতাবুল আজাব)।
আমাদেরকে এমনভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হবে যেন আমার দ্বারা কোনোরূপ অন্যায় কাজ সংঘঠিত না হয়। আমার হাত ও মুখ দ্বারা কারো ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ যেন আমি না করি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আমার কাছে থাকবে নিরাপদ। আল্লাহপাক আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/এমএস