রবিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব ও শিক্ষা
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অপার কৃপায় আমরা পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে প্রবেশ করেছি। মুসলিম উম্মাহর কাছে এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আরবি (হিজরি) ক্যালেন্ডারের হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস তৃতীয় মাস। এ মাসে দুনিয়ায় আগমন করেছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন ও শ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
নবিকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদের (সা.) সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি সাধন, ঐক্য বিধান ও সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্য। আল্লাহর নবিগণের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার জীবনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্গত। সারা জাহান যখন জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেসিত ঠিক তখনই পবিত্র এই রবিউল আউয়াল মাসে মহান আল্লাহপাক হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে পাঠিয়েছেন মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে।
পবিত্র এ মাসে মহানবির (সা.) সুন্দর ও উত্তম আদর্শে নিজেদের প্রতিটি কর্মকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করে তুলতে হবে। আমরা যদি মহানবির (সা.) আদর্শ নিজেদের মাঝে ধারণ করে জীবন পরিচালনা করি তবেই না আমরা তার প্রকৃত উন্মত বলে দাবি করতে পারব।
মহানবি (সা.) ছিলেন সারা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ। জন দরদি এই নবি (সা.) মানুষকে সকল প্রকার পঙ্কিলতা, অনিয়ম, অনাচার, পাপাচার ও অন্ধকারের বেড়াজাল হতে মুক্ত করতে আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন। তার সংগ্রাম ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার, তিনি রাজ্য দখলের জন্য সংগ্রাম করেন নি। সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা না পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হন নাই। নিজে বহু কষ্ট করেছেন, নানা বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন, জীবনের ওপরে বার বার হুমকি এসেছে তবুও তিনি পিছিয়ে যান নি। একাধারে বিরামহীন চেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তিনি জয়যুক্ত হয়েছেন। এভাবে সে কালের ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই মহান রাসুল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সুরা সাবা, আয়াত: ২৮)।
হজরত রাসুল (সা.) আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় আদর্শ। তার (সা.) পারিবারিক জীবন যেমন সুখময় সুন্দর ছিল তেমনি তিনি তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসাধারণ মানব রাসুল ছিলেন। যার মর্যাদা তুলনাহীন, অসীম আমরা যেন জীবনে তার (সা.) উত্তম পারিবারিক জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তম প্রতিফলন ঘটাতে পারি।
বিশ্বনবিকে (সা.) কেবল মক্কা শহর বা সেই দেশ বা সেই যুগের লোকদের জন্যই আবিভর্‚ত করেন নি। তিনি (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মানুষ ও জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তার (সা.) মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বার বার এই ঘোষণা করা হয়েছে যে, মহানবিকে (সা.) পৃথিবীর বিলুপ্তি সময় পর্যন্ত সর্বমানবের জন্য ‘রাসুল’ রূপে পাঠানো হয়েছে।
মানবেতিহাসে তার আবির্ভাব এক অনুপম ঘটনা। এর উদ্দেশ্য সকল পৃথক পৃথক জাতি ও বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীকে একই ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করা, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণজনিত সকল ভেদাভেদ বিলীন হয়ে যাবে। আজকে সমগ্র বিশ্ব যদি মহানবির (সা.) জীবনাদর্শের ওপর থেকে জীবন পরিচালনা করতো তাহলে বিশ্বময় এত নৈরাজ্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।
মহানবির (সা.) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার একটি অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম আর তিনি (সা.) মোটা পাড়ের চাদর পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। একজন বেদুইন এসে সেই চাদর ধরে এত জোরে হেঁচকা টান দেয় যে, যার কারণে মহানবির (সা.) গলায় চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে যায়। এরপর সে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! আল্লাহ প্রদত্ত এই সম্পদ দিয়ে আমার এই দু’টি উট বোঝাই করে দিন, কেননা আপনি আমাকে আপনার নিজস্ব সম্পদ থেকেও কিছু দিচ্ছেন না আর আপনার পৈত্রিক সম্পদ থেকেও দিচ্ছেন না।
একথা শুনে প্রথমে মহানবি (সা.) নীরব থাকেন এরপর বলেন, ‘আল মালু মালুল্লাহি ওয়া আনা আবদুহু’ অর্থাৎ সমস্ত সম্পদ আল্লাহরই আর আমি তার এক বান্দা মাত্র। এরপর তিনি (সা.) বলেন, আমাকে যে কষ্ট দিয়েছ তোমার কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেয়া হবে। তখন এই বেদুইন বলল, না! মহানবি (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কেন প্রতিশোধ নেয়া হবে না? সে বলল, কেননা আপনি মন্দকে মন্দ দিয়ে প্রতিহত করেন না। একথা শুনে হুজুর (সা.) হেসে ফেলেন। এরপর মানব দরদি রাসুল (সা.) সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন, এই ব্যক্তির একটি উটে জব আর অপরটিতে খেঁজুর বোঝাই করে দাও’ (আল শিফাউল কাযি আয়ায, প্রথম খণ্ড)।
আমাদের চিন্তা করার বিষয়, কত অতুলনীয় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্তই মহানবি (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই উত্তম আদর্শ তিনি শুধু মুসলমানদের সাথেই করতেন না বরং ইসলাম বিরোধী শত্রুদের প্রতিও প্রদর্শন করেছেন।
হজরত রাসুল (সা.) আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় আদর্শ। তার (সা.) পারিবারিক জীবন যেমন সুখময় সুন্দর ছিল তেমনি তিনি তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসাধারণ মানব রাসুল ছিলেন। যার মর্যাদা তুলনাহীন, অসীম আমরা যেন জীবনে তার (সা.) উত্তম পারিবারিক জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তম প্রতিফলন ঘটাতে পারি।
শুধু পবিত্র এ রবিউল আউয়াল মাসেই নয় বরং পুরো বছর জুড়ে আমরা যেন শ্রেষ্ঠনবির (সা.) জীবনী পাঠ এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। আল্লাহপাক আমাদেরকে মহানবির (সা.) অনুপম আদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস