কোটা আন্দোলন

সবার পরাজয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১১:৪৪ এএম, ২৭ জুলাই ২০২৪

আমাদের বিস্ময়বোধ যে কত প্রবল কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশে সংগঠিত অপকর্মগুলোতে তার পরিচয় মিলেছে। এত এত মৃত্যু আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের মতো বীভৎসতায়, হিংসার নৃশংসতায়, উন্মত্ততায় আর বর্বরতায় স্তম্ভিত আমাদের বিস্ময়ের শেষ নেই। আমরা আর কোনো আন্দোলনে এত মানুষের মৃত্যু, এত ধ্বংস দেখিনি।

অথচ পুনরাবৃত্ত এই অপকর্মগুলোর উৎস যে দেশে বরাবরই বিরাজমান সেটা ভেবে একটু গভীর হলে তা এড়ানো যেতো। আক্ষেপের কথা, আমরা প্রায়শই বিচ্ছিন্ন বৃক্ষগুলোকে দেখি, কিন্তু এই বৃক্ষরাজির সমাহারে সৃষ্ট অরণ্য আমাদের চোখে পড়ে না। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে শুধু বল প্রয়োগে বা আদালতের দোহাই দিয়ে উপেক্ষা করার চেষ্টা ছিল, সমাধান চায়নি তারা যাদের হাতে সমাধান ছিল। আর চায়নি বলেই আন্দাজ করে তারা বলেছেন যে, শিক্ষার্থীদের ভিতর জামাত-বিএনপি ঢুকে পড়ছে, কিন্তু আলোচনা করে, শান্তিপূর্ণ সমাধান করে সেই প্রবেশ বন্ধ করার উদ্যোগ নেন নি।

এখন কারফিউ দেশে, হয়েছে সেনা মোতায়েন। ছাত্রলীগ আক্রমণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেরাই বিতাড়িত হয়ে ভাল শিক্ষা পেয়েছে। জনপদে জনপদে আওয়ামী লীগ নামার সাহস পায়নি, কিংবা যারা নেমেছিল তারা টিকে থাকতে পারেনি। ছাত্রছাত্রীরা মারা গেছে, শিশু, নারীসহ সাধারণ মানুষ মারা গেছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী মারা গেছে, পুলিশ সদস্যরা মারা গেছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সবাই আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু আর সহিংসতার শিকার হয়েছে কোন না কোনোভাবে। আজ কার্ফিউ দিয়ে কিছুটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর এখন ভাববার পালা জয় হলো কার? নাকি পরাজয় বরণ সবাই মিলে?

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটা জয় হয়েছে, কারণ তারা যেটুকু কোটা চেয়েছে তার চাইতে বেশি পেয়েছে। কিন্তু তাদের অসংখ্য সতীর্থের প্রাণ গেছে, অনেকেই গুরুত্ব আহত হয়েছে, তাদের শিক্ষার ক্ষতি হচ্ছে। সরকার শেষ পর্যন্ত থামাতে পেরেছে, কিন্তু ভাবমূর্তি আর আর রাষ্ট্রীয় সম্পদের যে ক্ষয় হয়েছে তা তাদের কল্পনাতীত। একটা সময় হয়তো সবই নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু ইতিহাসে এই আন্দোলন যেভাবে লেখা হবে তা কারও জন্য স্বস্তিদায়ক হবেনা।

বড় ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। তাদের রোজগার থেমে গেছে, ইন্টারনেটের ব্ল্যাকআউটে ছোট থেকে বড় ব্যবসা পথে বসেছে। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে সেই পরিবারগুলোর যারা স্বজন হারিয়েছে। পক্ষ বিপক্ষ কোনো পক্ষই এদের খোঁজ রাখবে না কোনদিন।

এই অবস্থা নতুন করে নড়িয়ে দিয়েছে অর্থনীতির ভিতকে। এমনিতেই তলানিতে দেশের অর্থনীতি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন অবস্থার সাথে লাগামহীন দুর্নীতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে রেখেছে ভয়ংকরভাবে। নতুন করে এই অচলাবস্থা কারখানার উৎপাদন কমাবে, সেবাখাত-কে বিপর্যস্ত করবে, এবং একটা দীর্ঘ মন্দাভাব নিয়ে আসবে পুরো অর্থনীতির চক্রে যার কারণে প্রবৃদ্ধির হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ আন্দাজও করতে পারছে না। করোনা কালে চাকরি হারিয়েছেন বহু মানুষ, এখন আবার হারাবে অনেকে। ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা সাময়িকভাবে চলে যাচ্ছে নেপালে, স্থায়ীভাবেও অন্যদেশে স্থানান্তরিত হবে আনেক ব্যবসা।

অর্থাৎ লম্বা সময়ের স্থবিরতা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করবে। একটা চাকরির আন্দোলন যে শেষ পর্যন্ত এমন হিংস্র দাঙ্গায় পরিণত হবে কেউ হয়তো ভাবতেও পারেনি। বেশি উপার্জন হারাচ্ছেন অতি দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে সময়েও সরকার প্রধান বিরক্ত হয়ে সব কোটা বন্ধ করে দিয়ে পরিপত্র জারি করেছিলেন। কিন্তু সমাধান করা হয়নি। একটা সমস্যা এত বছর ধরে জিইয়ে রাখাটাই তো শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেয় যে কী চলছে দেশে।

সরকারি বয়ান এখনও এমন যে, ছাত্রদের ঘাড়ে ভর করে সহিংসতা ছড়িয়েছে জামাত-বিএনপি। সেটা ঠিক। সেটা যে তারা করবে সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকলে তো সমাধানের চেষ্টাই হতো বুদ্ধিদীপ্ত কাজ। তা করা হয়নি। দ্বিতীয় হলো এত মানুষকে সম্পৃক্ত করে এত পরিকল্পিতভাবে নাশকতা করতে পারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের ব্যর্থতাই তুলে ধরে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, এত মানুষের রাস্তায় নেমে আসাকে শুধু জামাত-শিবির বা বিএনপি বয়ানে দেখলে সমস্যার গভীরে প্রবেশ কোনোদিনই হবেনা।

যারা মানুষ মেরে ঝুলিয়ে রেখে হিংস্রতা দেখিয়েছে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কারা। তারা অপেক্ষায় আছে তাদের আমল কবে আসবে সে জন্য। ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার এত দাপট যে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে দৃশ্যপট থেকে। একটা আমরা-ওরা বিভাজন শুধু শাসক-বিরোধী দলের নয়, প্রশাসক, রাজনৈতিক দল এবং জনগণেরও বিভাজন করে ফেলেছে।

শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন ছাত্রলীগই যথেষ্ট। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে যে, এরা কেবল পরিস্থিতি নষ্ট করতেই যথেষ্ট। শাসক দলের নেতারা কি বুঝলেন এবার যে, তাদের কর্মীরা সংযত না থাকলে কি ঘটে? যা স্বাভাবিক, যা ন্যায্য সেটা না করে সবাইকে উপেক্ষা করাই হলো দম্ভ। জনগণকে উপেক্ষা করা কোনো রাজনীতি নয়। ভালোবাসা আর সহমর্মিতার রাজনীতি করতে পারছে না শাসক দল। এবার সেই চেষ্টা কি করবে?

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন