মৃত্যুটাই বাস্তব, বেঁচে থাকাটাই যেন অস্বাভাবিক!


প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

একের পর এক চাপাতির কোপে প্রাণ হারাচ্ছেন এদেশের প্রগতিবাদী মানুষ। যারা জ্ঞান চর্চা করেন, যারা উদারতায় বিশ্বাস করেন, যারা অন্ধকারকে পিছে ফেলে আলোর পথে হাঁটতে শেখান সেই সব মানুষেরা খুন হয়ে চলেছেন। খুনিরা তাদের তরিকায় বিশ্বাসী নয় বলে খুনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। আর আমরা খুঁজে বেড়াই খুন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন বৃত্তান্ত। হারিয়ে যায় তাদের পরিচয়।

তারা শিক্ষক, তারা লেখক, তারা কবি, তারা বেহালা বাদক, তারা নৃত্যশিল্পী, তারা বিজ্ঞানী, তারা মানবতার সেবক-এই সব পরিচয় ছাপিয়ে আমরা তাদের বানিয়ে দেই হয় ব্লগার, নয় সমকামি, নয় নাস্তিক। আমরা তাদের মানুষ পরিচয়টুকুও লুকিয়ে ফেলি। হতে পারে নাস্তিক সে মানুষতো। তারও যেন বেঁচে থাকার অধিকার নেই। রাষ্ট্র যেমন ওইসব খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে দিয়েছে, আমরাও কী খুনের বিচার দাবি না করে, প্রতিরোধ গড়ে না তুলে এসব হত্যাকে অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছি না?

রাষ্ট্র চুপ। তাদের মধ্যে খুনিদের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলো চুপ। তাদের ভোট দরকার। সুশীল সমাজ চুপ। তারা নিরিবিলি বাঁচতে চায়। তরুণরা চুপ। তারা হতাশ। কে প্রগতিবাদের পক্ষে লড়াই করবে? কেউই তো নেই সেই সব মানুষদের পাশে যারা প্রতিনিয়ত খুন হয়ে চলেছে। খুনের বহর দীর্ঘতর তো হতেই থাকবে।

প্রায় শুনি, আমরা এদেশের মানুষ সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে চলেছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মডারেট মুসলমান। এদেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিবে না। আমরা আরো শুনি, এদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। আমরা এমন অনেক কিছুই শুনি কিন্তু আসলে কী আমরা তাই যে রকমটা শুনে এসেছি। যে পিতা দেশকে জন্ম দিলেন, তাকে আমরা সাড়ে তিন বছরের মাথায় খুন করেছি। প্রতিবাদ কি করেছিলাম তখন?

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র বানালেন সামরিক শাসকরা। কতোটুকু প্রতিবাদ হয়েছিল তখন? ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে যে রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণে নির্বাচিত শাসকরাই বা কী করেছেন? তারা কি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন ৭১এ। আমরাও কি সেটা চেয়েছি? ৭১ এর পরাজিতরা রাষ্ট্রশাসন করেছে দীর্ঘ সময়। আমরা কি তাদের বৈধতা দেইনি? তাদের গাড়ীতে আমাদের লাল সবুজ পতাকা তুলে দেয়নি? শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের হোলি খেলা নীরবে দেখে যাইনি? আমরা কী উদার হতে পেরেছিলাম কখনো?  তাহলে আজ ধর্মান্ধরা মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করলে প্রতিবাদ হবে কেন? তাতো হওয়ার কথাও নয়, হচ্ছেও না। হাহাকার কেন করি?  বরং আসুন আমরা অপেক্ষা করি কাল আরো একটি মৃত্যুর জন্য।

না, আমরা হতাশ নই। আমরা উদার হতে পারিনি ঠিকই।  জাতির জনকের খুনিদের বিচার হতে লেগেছে ২৩ বছর। আর রায় কার্যকর হতে লেগেছে আরো ১১ বছর। তার কন্যাকে হত্যার চেষ্টার বিচার চলছে ১২ বছর ধরে, শেষ কবে হবে কেউ জানে না। আর সেই সব নরপিশাচ যারা ৭১ এ আমাদের আলোর পথের যাত্রীদের খুন করেছে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি লাগাতে লেগেছে ৪২ বছর। হয়তো  আরো ৪২ বছর পর আজকের খুনিরা বিচারের কাঠগড়ায় ওঠবে। কিন্তু ততদিন আমরা বেঁচে থাকবো না। তার অনেক আগেই হয়তো চাপাতির কোপে আমাদের দেহ থেকে আত্মাটা ছিন্ন হয়ে যাবে। রাষ্ট্র বলবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মৃত্যুটাই বাস্তব। বেঁচে থাকাটাই যেন অস্বাভাবিক।

লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।