বিএনপি গড়ছে না ভাঙছে?
এবারের ঈদটা ভালো কাটেনি বিএনপি নেতাকর্মীদের। অবশ্য টানা ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদের ঈদ অনেক দিন ধরেই ভালো কাটছে না। তবে এতদিন মামলা-হামলা, দমন-পীড়ন ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। আর এবারের ঝড়টা এসেছে দলের ভেতর থেকে।
ঈদের আগের এই মধ্যরাতের ঝড়ে এখন টালমাটাল বিএনপি। বড় থেকে ছোট, ছোট থেকে মাঝারি- সব ক্ষেত্রের নেতারা এখন নিজেদের চেয়ার সামলাতে ব্যস্ত। কার পদ থাকবে, কার পদ যাবে; কার প্রমোশন, কার ডিমোশন হবে- তা নিয়ে শঙ্কায় কারো ঘুম নেই। নেতাদের টেনশন সংক্রমিত হয়েছে কর্মীদের মাঝেও। মাথার ওপর নেতা না থাকলে, কর্মীদের বিপদ আরো বাড়ে।
বিএনপির সাংগঠনিক এই সাইক্লোন এসেছে কোনো রকমের সিগন্যাল না দিয়েই। হঠাৎ করেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একের পর এক কমিটি ভেঙে দেওয়া, দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ওলটপালটে তোলপাড় সর্বত্র। এই আলোচনা শুধু দলের ভেতরে নয়; সব জায়গায় একই প্রশ্ন বিএনপি গড়ছে না ভাঙছে?
বিএনপি টানা ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে দেশ শাসন করছে। এই সময়ে বিএনপি মূলত বর্জনের রাজনীতি করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বারবার তারা নিজেদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রেখেছে। নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও সেটা ছিল নামকাওয়াস্তে। জাতীয় নির্বাচন তো বটেই, এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও তারা অংশ নেয়নি।
বিএনপি বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু এই এক সত্য বারবার প্রমাণ করতে গিয়ে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতেই নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ক্যান্টনমেন্টে জন্ম হলেও স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থেকে বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক চরিত্র দিতে পেরেছে। এরশাদের পতনের পর নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। এরপর স্বল্প মেয়াদে ও পূর্ণ মেয়াদে আরো দুই দফা সরকার গঠন করে বিএনপি। ক্যু করে বা বিপ্লব করে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই।
স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক দল হিসেবেই ক্ষমতায় ফিরতে হবে বিএনপিকে। কিন্তু দিনের পর দিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে সেটা কীভাবে সম্ভব? নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে বিএনপি আসলে জয়ের নিশ্চয়তা চায়। সেটা কে দিতে পারবে। জেতার জন্য মাঝে মধ্যে হারতে হয়, এগোতে হলে কখনো কখনো পেছাতেও হয়; এই ধারণাটাই নেই বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্ষসতাসীনদের লক্ষ্যও তাই ছিল। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ’৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। মাত্র ৩৯টি আসন পেলেও সেই নির্বাচনই ছিল আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ। গণতন্ত্র চাইলে নির্বাচনও চাইতে হবে। নির্বাচন হতে পারে, আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
ধরে নিচ্ছি, নির্বাচনে গেলে বিএনপি হারতো, আওয়ামী লীগ জিততো। বিএনপি না গিয়ে তো আওয়ামী লীগের জয় আরো সুনিশ্চিত করেছে। আর গেলে অন্তত ১০০ আসনও যদি পেতো, তাহলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের আসনে বসতে পারতো। ভারতের কংগ্রেস কিন্তু হারতে হারতে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জয় নিশ্চিত না হলে নির্বাচন বর্জনের ভাবনাটা গণতান্ত্রিক নয়। বর্জন করে যদি নির্বাচন প্রতিহত করতে পারতো, তাহলেও না হয় কথা ছিল। বিএনপি বারবার নির্বাচন বর্জন করছে আর আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসছে। তাতে লাভ কার হচ্ছে? বিএনপির না আওয়ামী লীগের?
৭ জানুযারির নির্বাচনের আগে বিএনপি সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের আন্দোলনের ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, দেশের জনগণ নয়, তাদের মূল ভরসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে গাছে তুলে মই সরিয়ে নিলে তাদের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। অবশ্য বিএনপি শুরুর আগেই আন্দোলনে হেরে বসেছিল। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর বিএনপিকে আর মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সক্রিয় সব নেতাই হয় কারাগারে নয় পালিয়ে ছিলেন।
২৮ অক্টোবরের পরেই আসলে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ছন্নছাড়া হয়ে যায়। বারবার বিএনপি আন্দোলনে নামে এবং বারবার ব্যর্থ হয়। ১৫ বছর ধরে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি। নিশ্চয়ই দলে এই ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয়েছে। আমার বিবেচনায় কর্মীদের কোনো সমস্যা নেই। জনসমর্থনেও কমতি নেই। বিএনপি যখনই মাঠে নেমেছে, কর্মীরা জীবন দিয়ে মাঠে থেকেছে। আসল সমস্যা নেতৃত্বে, সমস্যা নীতি নির্ধারণে। সরকারের একদিনের ধাক্কায় যদি একদফা আন্দোলনের দফারফা হয়ে যায়, তাহলে এমন আন্দোলন করার দরকার কী।
বিএনপি না গিয়ে তো আওয়ামী লীগের জয় আরো সুনিশ্চিত করেছে। আর গেলে অন্তত ১০০ আসনও যদি পেতো, তাহলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের আসনে বসতে পারতো। ভারতের কংগ্রেস কিন্তু হারতে হারতে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জয় নিশ্চিত না হলে নির্বাচন বর্জনের ভাবনাটা গণতান্ত্রিক নয়। বর্জন করে যদি নির্বাচন প্রতিহত করতে পারতো, তাহলেও না হয় কথা ছিল। বিএনপি বারবার নির্বাচন বর্জন করছে আর আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসছে। তাতে লাভ কার হচ্ছে? বিএনপির না আওয়ামী লীগের?
বলা হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্বে রদবদল আন্দোলনে ব্যর্থতার মূল্যায়ন। কিন্তু যাদের সরিয়ে যাদের আনা হয়েছে, তাদেরই বা সাফল্যের ইতিহাস কোথায়। ব্যর্থতার দায়ে সরাতে হলে তো ঠক বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে। তবে দায় নিতে হবে মূল নেতৃত্বকেই। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি চেয়ারপারসন হলেও তার আর রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডনে বসে ১৬ বছর ধরে দল চালাচ্ছেন। কিন্তু লন্ডনে বসে রিমোট কন্ট্রোলে যে বিএনপির মতো একটা বড় দল চালানো সম্ভব নয়, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভদ্রলোক। কিন্তু দলে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। লন্ডন থেকে তারেক রহমানই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এবারের রদবদলটাও এসেছে দলে তারেক রহমানের ক্ষমতা আরো নিরঙ্কুশ করতে। এই যে এমন প্রলয়ঙ্করী রদবদল, তারেক রহমান ও রুহুল কবির রিজভী ছাড়া দলের আর কেউ সেটার বিন্দুবিসর্গও জানতেন না।
লন্ডন থেকে তারেক রহমান পাঠিয়েছেন, রিজভী খালি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করেছেন। গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনে এমন অগণতান্ত্রিক সাংগঠনিক কার্যক্রম আন্দোলনের মূল চেতনার সাথেই সাংঘর্ষিক। যে দলটি আট বছরে একটা কাউন্সিল করতে পারে না, তারা সরকার পতনের আন্দোলন করবে কীভাবে?
গত ১৮ বছরে বিএনপির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো দলকে অখণ্ড রাখতে পারা। সরকারি দলের মামলা, হামলা, গুম, দমন, পীড়ন, প্রলোভন সত্ত্বেও সে অর্থে বিএনপিতে বড় কোনো ভাঙন হয়নি। দু-একজন ব্যক্তিবিশেষের দল ছেড়ে যাওয়া বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু লক্ষ্যহীন আন্দোলনে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে বিএনপি কতদিন টিকে থাকতে পারবে, সেটা নিয়ে শঙ্কা আছে।
সরকার পতনের একদফা আন্দোলন বিএনপি প্রত্যাহার করেনি। তার মানে তারা এখনও আন্দোলনেই আছে। আমরা ধরে নিচ্ছি, আন্দোলনে এখন বিরতি। আবার আন্দোলনে নামা ছাড়া বিএনপির সামনে আর পথ খোলা নেই। দল পুনর্গঠন করেই হয়তো তারা আবার মাঠে নামার চেষ্টা করবে। কিন্তু সমস্যা হলো, পুনর্গঠনে দল যতটা শক্তিশালী হবে, দুর্বল হবে তারচেয়ে বেশি। গত নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার চেয়ে আতঙ্ক বেশি। সরকারি দল ভয় দেখিয়ে বা চাপ দিয়ে বিএনপির যত নেতাকে নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে; বিএনপি বহিষ্কার করেছে তারচেয়ে বেশি।
গত কয়েক বছরে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে কয়েকশ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয় নেতাদের বহিষ্কার করায় দল আরো দুর্বল হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বিএনপির আন্দোলনে মানুষ সাড়া দেবে কি না, সংশয় আছে তা নিয়েও। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপির সব আন্দোলন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য। জনগণের এত সমস্যায় বিএনপির যেন কিছুই যায় আসে না। এমন জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলনে জনগণ আসবে কেন।
নেতৃত্বের ওলটপালটে দলে অসন্তোষ আরো বেড়েছে। যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলেননি। কারণ বিএনপিতে এখন এক ব্যক্তির শাসন চলছে। প্রশ্নহীন আনুগত্য ছাড়া এখানে নেতা হওয়া যায় না। সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই আপনাকে দল ছাড়তে হবে বা ডিমোশন হবে। তবে নেতৃত্বের এই রদবদল বিএনপিকে আরো সংগঠিত করবে নাকি ভাঙনের দিকে ঠেলে দেবে; সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো।
২৩ জুন, ২০২৪
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস