আমাদের আছেন একজন শেখ হাসিনা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার পর সামরিক শাসনের জাঁতাকালে পিষ্ট হতে থাকে বাংলাদেশ। এ সময় বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর অসংখ্যবার হত্যা চেষ্টা করা হয় শেখ হাসিনাকে। আর এ কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে। সত্যিই যদি আমাদের একজন শেখ হাসিনা না থাকতেন, তাহলে কি হতো?
স্বৈরশাসকরা যখন নানা ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে লিপ্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যখন পদে পদে অপমানিত করা হচ্ছে, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলো সংকটে নিমজ্জিত, তখনই ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেয়া আওয়ামী লীগকে নিয়েই গণতন্ত্র, ভাত ও ভোটের যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। এখনও সেই যুদ্ধ চলমান।
এই দীর্ঘ পথ চলায় প্রায় ১৯ বার হত্যা চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। কিন্তু তিনি প্রায়ই বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে হারিয়েছি। আমার আর হারানোর কিছু নাই। আপনারা (দেশের জনগণ) আমার পরিবার।‘ আর সেই পরিবারকে রক্ষায় শেখ হাসিনা সংগ্রহ করে যাচ্ছেন তার পিতার মতই।
দেশে এসেই বাংলাদেশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী দলটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয় দলটিকে। সেই দলের জৌলুস আবারও ফেরাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন যিনি তিনি হলেন শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে আওয়ামী লীগ ও নৌকা প্রতীককে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। হত্যা, গুম, দীর্ঘ কারাবরণ সহ এমন কোন অত্যাচার নেই যা সহ্য করতে হয়নি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। এমন এক পর্যায় থেকে দেশের মানুষের হৃদয়ে থাকা আওয়ামী লীগকে আবারও সকলের সামনে মেলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে তিনি পরিচিতি পান গ্রামের মানুষের কাছে ‘শেখের বেটি’ হিসেবে। তিনি হয়ে ওঠেন বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতীক। দেশের উন্নয়নের প্রতীক। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি একজন যোদ্ধা, একজন অভিভাবক ও একজন ক্রাইসিস ম্যানেজার। জাতির পিতার রক্ত, স্বপ্ন, দ্রোহ আর বেদনা বুকে ধারণ করে তিনি হয়েছেন বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্নসারথি। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আজকের ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মতো তার চরিত্রে মানুষের প্রতি বিশ্বাস-ভালোবাসা, সততা, দক্ষতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার বিশেষ গুণ বিদ্যমান। দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছে তার সাহসিকতা ও মানবতার রাজনীতি। সংকটকালে দাঁড়িয়েও ‘আরও সবুজ, আরও পরিচ্ছন্ন এবং আরও নিরাপদ’ বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন তিনি।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সভানেত্রীর দায়িত্ব পান। নেতৃত্বের কোন্দলে বিভাজিত দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ক্রাইসিস মোকাবিলায় সফল হন। তখন সময়টা ছিল তাঁর জন্য খুবই প্রতিকূল। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা নয় বছর রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২১ বছর পর পথ হারানো বাংলাদেশ আবার সঠিক পথে চলতে শুরু করে।
প্রশাসন ও অন্যান্য স্তরে তখন স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামীবিরোধীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সেই জঞ্জালপূর্ণ অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব নিয়ে জমাট বারুদের ওপর থেকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। দক্ষতার সঙ্গে তিনি সব সামলে নেন। দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে কয়েক দশকের চলমান চরম সংকট নিরসন করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সালের বন্যায় ২ কোটি বন্যার্ত মানুষের কাছে বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে অনন্য নজির স্থাপন করেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে টানা চার মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন।
সংকট মোকাবিলায় প্রতিবারই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় তার দেড় মাসের মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহে ঘটনা ঘটে। তখন সেনাবাহিনী ও সরকার প্রায় মুখোমুখি অবস্থায় চলে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সংকট মোকাবেলা করেন। একটি সংকটময় পরিস্থিতি থেকে জাতিকে উদ্ধার করেন। সেকথা আদালতও বলেছে। বিডিআর বিদ্রোহ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী ও সঠিক সিন্ধান্ত গ্রহণে শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, বিডিআর বিদ্রোহের ভয়াবহতা ও আকস্মিকতায় সদ্য নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্য্য, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সাথে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমনের যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিন্ধান্ত ছিল দূরদর্শিতাপূর্ণ।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামকে দিয়ে ঢাকা শহর দখলের দ্বিবাস্বপ্ন দেখেছিল বিএনপি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সেদিন এই ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয় বিএনপি। পদ্মাসেতু বাংলাদেশের গর্ব ও জাতির অহংকার। অথচ এই পদ্মাসেতু তৈরি সম্ভব হয়েছে একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার কারণে। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মাসেতু থেকে বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রকল্প থেকে সরে আসে তখন অন্যান্য দাতা সংস্থা গুলোও সরে যায়। তখন পদ্মা সেতু নির্মান নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি। দেশের তথাকথিত অর্থনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবীরা একবাক্যে বলেছিল বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া এতবড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব না। তাদের সাথে সুর মিলালেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও। এমন সংকটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মান করবেন। অনেকেই এটিকে কথার কথা মনে করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পদ্মাসেতু তৈরি করে প্রমান করলেন তিনি যেটা বলেন, সেটা করে দেখান। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটুকু মজবুত সেটা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মান করে শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন। এর পাশাপাশি মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের স্বপ্নছোঁয়ার প্রচেষ্টার আরেক নাম।
গত দুই দশকে পৃথিবীর কোনো জাতীয় নেতা শেখ হাসিনার মতো এরকম সফলতা দেখতে পারেনি। তাঁর সফলতার গল্প আজ বিশ্ব নেতাদের মুখে মুখে। তাঁর উন্নয়ন কৌশল আজ পৃথিবীর নানা দেশ অনুসরণ করছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে আজ সফলতার এক প্রতীক। তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে। যদি আমাদের একজন শেখ হাসিনা না থাকতো, তাহলে কি হতো? এই উন্নয়ন ও বিশ্বের বুকে মর্যাদার অবস্থান কী আমরা পেতাম?
করোনা মোকাবিলায় অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো আশংকা প্রকাশ করেছিল করোনায় বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মারা যাবে। শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে করোনা মোকাবেলায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গবেষকদের আশংকাকে ভুল প্রমানিত করেছেন। যার কারণে ২০২০ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিনে ‘লিডারশিপ স্ট্যাটেজি’ শিরোনামে করোনা মোকাবেলায় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কতিপয় বিশ্বনেতাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামও একই ভাবে প্রশংসা করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর সব দেশেই এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশেরও আমদানি-রপ্তানি খাত সহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ডলার সংকট, রিজার্ভ কমতে শুরু করে, বিরোধীরা যখন শ্রীলঙ্কা হওযার দুঃস্বপ্নে বিভোর তখন প্রধানমন্ত্রীর জাদুকরী সিন্ধান্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। কয়লা সংকটে যখন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় তখন ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটের কবলে পড়ে দেশ। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন একমাস এই সমস্যা থাকবে। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যায় হাত দেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই বিদ্যুতের সমাধান হয়ে যায়। তিনি ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ এনে সংকট সমাধান করেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেমন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনই ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার নির্দেশেই দেশজুড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬০টি মডেল মসজিদ। এমনকিকরোনাকালে সারা দেশের মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা ও এতিমখানার উন্নয়ন এবং এসবের সঙ্গে যুক্ত প্রায় অর্ধকোটি মানুষের জন্য নগদ অর্থ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এসব খাতে আড়াইশ’ কোটি অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশকে গড়ে তুলছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা আজ পূর্ণতা পেয়েছে। সোনার বাংলার লক্ষ্য অর্জন শেষে বাঙালি জাতি এখন এক নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিমুখে যাত্রা করছে। দেশের যেদিকে তাকাই শুধু নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান হয়।
জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল কেউ গৃহহীন থাকবে না। সবার থাকার ব্যবস্থা করে দেবে সরকার। আর সেই লক্ষ্য অর্জন করতেই সমস্ত কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৫ম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদুল আজহার আগে উপহার হিসেবে সারা দেশে আরও ১৮ হাজার ৫৬৬ ভূমি-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর হস্তান্তর করেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে দেওয়া বাড়িগুলো গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা এনে দিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষকে বিনামূল্যে ঘর প্রদান করে পুনর্বাসন করেছে। এতে তাদের জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে এসেছে।
শুধু উন্নয়নই নয় বঙ্গবন্ধুকন্যার মানবিক নেতৃত্বে, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনমান আমূল বদলে গেছে। অভাব, মঙ্গা ও দারিদ্রের কড়াল গ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১০ লক্ষাধিক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। নতুন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষের। নামমাত্র মূল্যে সার ও বীজ পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা তার শাসনামলে অনেক অসাধ্য কাজ সম্পাদন করেছেন। যে পার্বত্য চট্টগ্রাম একসময় অশান্ত ছিল। বাংলাদেশের আইন সেখানে কার্যকর প্রায়ই অসম্ভব ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন। যার কারণে সেখানে এখন শান্তি বিরাজ করছে। সেসময় কালে ভারতের সাথে করা হয়েছিল পঁচিশ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি। তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতা ছাড়া ভারত ও মায়ানমারের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি ইতিহাসে বিরল। ১৯৬৫ সাল থেকে অমীমাংসিত ভারতের সাথে স্থল সীমানা চুক্তি সহ অনেক জটিল কাজ সমাধান করেছেন।
বাংলাদেশকে স্বল্পন্নোত দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে গেছেন। এজন্য দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। তার গৃহীত পদক্ষেপে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শেখ হাসিনা গৃহীত উদ্যোগ গুলো হলো-একটি বাড়ি একটি খাসার, ডিজিটাল বাংলাদেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ, পরিবেশ সুরক্ষা সহ আরো অনেক সামাজিক কর্মসূচি।
শেখ হাসিনা। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের উত্তরসূরি। বিশ্ব পরিমন্ডলে কখনো ‘ভ্যাকসিন হিরো’, কখনো ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’, কখনো ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’, কখনো ‘ইস্টার অব ইস্ট’, কখনো ‘স্টেটসম্যান’, কখনো শান্তির অগ্রদূত, কখনো নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সোচ্চার কণ্ঠস্বর, কখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা সৎ ও পরিশ্রমী প্রধানমন্ত্রী, কখনো গণতন্ত্রের মানসকন্যা আবার কখনো তিনি উন্নয়নের ম্যাজিশিয়ান। তিনি আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারের বাংলাদেশকে আলোকোজ্জ্বল উন্নয়ন অভিযাত্রায় শামিল করেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে নিয়ে গেছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের বাতিঘর, আশা-আকাক্সক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল। কোটি কোটি মানুষের কাছে পরম মমতাময়ী মায়ের স্থানে অধিষ্ঠিত।
বিশ্ব কূটনীতিতে এখন অন্যতম আলোচিত নাম শেখ হাসিনা। একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি সারা বিশ্বের রোল মডেল। শান্তিপূর্ণ উপায়ে কিভাবে সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায় তার রোল মডেল হলেন শেখ হাসিনা। আবার অন্যদিকে তিনি একজন মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্ব কূটনীতিতে প্রশংসিত, আলোচিত। বিশেষ করে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তিনি মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা এ সমস্ত কূটনীতিক তৎপরতা এবং কূটনীতিক বিচক্ষনতা বিশ্ব ডিপ্লোম্যাসিতে এক আলোচনার বিষয়। করোনার সংকটের সময় শেখ হাসিনা বিশ্ব কূটনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে হর্ষ বর্ধন শ্রীংলার ঢাকায় ছুটে আসা, শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করার পর শেখ হাসিনার কূটনীতিক চমক নতুন করে আলোচিত হচ্ছে।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে সব ব্যাপারে নাক গলাত বিদেশীরা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের মুরুব্বী দেশগুলো বাংলাদেশে কিছু ঘটলে হাহাকার করে উঠত। রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশকে কি করতে হবে না করতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতো। শেখ হাসিনার দক্ষ কূটনীতি ও বিচক্ষণতার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ এখন বন্ধ হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন বা অন্যান্য বিষয়ে যে কথায় কথায় বিভিন্ন দুতাবাসের বিবৃতি দেওয়া বা মন্তব্য করার প্রবণতাগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের মতো দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর এই ধরণের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বিশ্বে উন্নয়নের জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এক ধরণের অনুপ্রেরনা। ১০ লাখ রোহিঙ্গা যখন আশ্রয় নিয়েছিলো বাংলাদেশে। তখন অনেকে বলেছিল যে, মিয়ানমারের পক্ষে অনেক দেশ আছে। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন, ভারতের কথা বলা হচ্ছিলো। শেখ হাসিনা জেনেবুঝে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। তিনি এমন কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছেন যার কারণে সারা বিশ্বে মিয়ানমার এখন ধিকৃত হচ্ছে। মানবাধিকার প্রশ্নে রোহিঙ্গাকে একঘরে করা হয়েছে। এটাও শেখ হাসিনার কূটনীতির একটি বড় বিজয়। চীন-ভারতের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক রেখে গেছেন শেখ হাসিনা। চীনের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে ভারত তাদের শত্রু হয়। আবার ভারতের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে চীন রুষ্ট হয়। এ রকম একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও শেখ হাসিনা বিশ্বে একমাত্র দেশ যিনি চীন এবং ভারতের সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে এবং প্রায় সমান উচ্চতায় সম্পর্ক রেখেছে। চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীন সবচেয়ে বড় পার্টনার। আবার অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং দুই দেশের সম্পর্ক গত এক দশকে এক নূতন উচ্চতায় উঠেছে। এই দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা সেটি সাড়া বিশ্বের জন্য একটা চমক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে তাঁর নেতৃত্বে সংকট কাটিয়ে অদম্য গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। নানা বিরোধ ও কোন্দল দূর করে দলকে সুসংগঠিত করা, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও নির্বাচন ব্যাহত করার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি মোকাবিলা, সেরা কূটনৈতিক সাফল্যের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের ছিটমহল সমস্যার সমাধান ও সমুদ্রসীমায় বিজয় অর্জন, ১/১১ সরকারের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা তাঁর অকল্পনীয় সাফল্য। যদিও এর কোনোটাই সহজ ছিল না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভয়াবহ প্রতিকূলতা ও ক্রাইসিসকে দৃঢ়তার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে মোকাবিলা করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকদের বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ম্যাজিক বা রহস্য হলো বর্তমান সরকারের তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতিকৌশল এবং নানা ইতিবাচক উদ্যোগ। শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে রেকর্ড পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, মূল্যবোধ, কৃষি, অর্থনীতি, রেমিট্যান্স, বিদ্যুৎ, বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নয়নসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশবাসীকে যুগান্তকারী সাফল্য এনে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
এই অবদানগুলোর কারণে গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশী ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শিশু মৃত্যু হ্রাসসংক্রান্ত MDG-4 অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড, বিশ্বখ্যাত ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক ২০০৯’, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১: ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট হেলথ, বাংলা অ্যাকাডেমির সম্মাননা সূচক ফেলোশিপ। প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইউনেস্কোর কালচারাল ডাইভারসিটি পদক ও শান্তিবৃক্ষ পদক (Peace Tree Award), জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবিলায় সাফল্য প্রদর্শনের জন্য জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ, প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’, গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারের মতো পুরস্কারও আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঝুলিতে।
তিনি গোটা জাতির দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জেগে থাকেন, তাই তো ১৭ কোটি বাঙালি নিশ্চিন্তে থাকে। জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতির কন্যা হলেও তাঁর চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না কখনো।
১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর শুরু হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। ওই সময় চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে মিছিলসহকারে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর হামলা করা হয়। এতে ৭জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হন।
পরবর্তীত ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাত ১২টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনা তখন ওই ভবনেই ছিলেন। সন্ত্রাসীরা ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা। এরপর ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন চলাকালে রাজধানীর গ্রিন রোডে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমাবর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের গুলি তার গাড়িতে লাগলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনমার্চ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হয়। সে সময় অসংখ্য গুলি তার বগিতে বিদ্ধ হলেও তিনি অক্ষত থাকেন। ১৯৯৫ এর ৭ ডিসেম্বর ওই দিন শেখ রাসেল স্কয়ারে সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৬ এর ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ৭ই মার্চের ভাষণের স্মরণে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আকস্মাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ চলতে থাকে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়।
১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলেমেয়েসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেইল চালাচালির খবর আসে। এতে জানানো হয় ওই ইমেইলটি পাঠিয়েছিলেন ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ২০০০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের অদূরে ও হ্যালিপ্যাডের কাছে পুঁতে রাখা হয় যথাক্রমে ৮৪ কেজি ও ৭৬ কেজি ওজনের দুটি বোমা । কিন্তু সৌভাগ্যবশত আগেই ওই বোমাগুলোর হদিস পেয়ে যান গোয়েন্দারা । শক্তিশালী বোমা দুটি বিস্ফোরিত হলে কেবল শেখ হাসিনাই নন, নিহত হতেন বহু মানুষ ।
২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিষয়টি আগে থেকে জানতে পেরে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানস্থলে বোমা পুঁতে রাখে জঙ্গি সংগঠন হুজির সদস্যরা। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতায় আগেই বোমাটি উদ্ধার ও নিষ্ক্রিয় করা হয়।
ওই বছর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে যান শেখ হাসিনা। সেখানে আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন স্থানে জনসভায় বক্তৃতা করার কথা ছিল তার। সে সময়ও জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রেখে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি। কিন্তু জনসভার একদিন আগে মাত্র ৫০০ গজ দূরের একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে হুজির দুই সদস্য নিহত হলে সে পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।
২০০২ এর ৪ মার্চ যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। এ বছর ২৯ সেপ্টেম্ব শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়ি বহরে হামলা চালানো হয়। বিএনপি-জামাত নেতা-কর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর ওই হামলা চালায়।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপির ঘাতক চক্র। একই বছর ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুরর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান এবং আরও ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত হন। এ ছাড়াও এই হামলায় আরও ৪শ জন আহত হন।
২০০৭ সালে সাবজেলে বন্দি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার খাবারে দেওয়া হয়েছিল স্লো পয়জন। উদ্দেশ্য ছিল, ক্রমাগত বিষ দিয়ে তাকে হত্যা করা। স্লো পয়জনিংয়ের কারণে একসময় শেখ হাসিনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ১১ জুন ১১ মাস কারাভোগের পর শেখ হাসিনা প্যারোলে মুক্তি পান।
২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সাথে বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসী চক্র সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চুক্তি করে এবং সেজন্য আগাম পেমেন্টও দেওয়া হয়। শ্রীলংকার সেই সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের আততায়ীদের টিম গাড়ি করে কলকাতা বিমানবন্দরে যাবার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনাটি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি লে. ক. শরিফুল হক ডালিম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে। যা উইকিলিকসের সৌদি আরবের এক গোপন বার্তায় প্রকাশ পায়। হংকংয়ে বসবাসরত এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ইসরাক আহমেদ এ পরিকল্পনায় অর্থায়ন করেন বলে গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে।২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৫০ জন নারী ও ১৫০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। এদের নেতৃত্বে রয়েছে ১৩ জঙ্গি দম্পতি। তবে প্রশিক্ষণরত অবস্থায়ই পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়।
২০১৫ সালের ৭ মার্চসোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে কারওয়ানবাজার এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণও ঘটায় তারা।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। তাকে বারবার কারাগারে রাখা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে ১৫ দিন কারাগারে রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দু’বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে এক মাস কারাগারে রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রদল ও শিবিরের দখলে চলে যায়। ২রা অক্টোবর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে নেয়। ওই সময় আওয়ামী লীগকে সভা-সমাবেশে বাধা, নেতা-কর্মী, সমর্থকদের হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় মামলাও নেয়া হতো না। উল্টো বাদীপক্ষকে পড়তে হতো পুলিশি হয়রানির মুখে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি, বাড়ির নারী সদস্যদের তুলে নেয়াসহ নানারকম নিপীড়নের শিকার হতে হয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। এই পুরো ৫ বছরে আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে আমেরিকার কথা মতো ভারতে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়েছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আর এভাবেই ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তারা।
এ নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর সংখ্যালঘুদের ওপর বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন আরও তীব্র হতে থাকে। বিএনপির ওই শাসনামলেই আওয়ামী লীগের সাংসদ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি আহসানউল্লাহ মাস্টারকে সন্ত্রাসীরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে তাঁর তিনসহযোগীসহ হবিগঞ্জে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। সেইসঙ্গে ঘটে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা।
২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য এই কাজ করেছিল বিএনপি সরকার। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির ক্ষমতা ধরে রাখার অপচেষ্টার কারণে ২০০৬ সালের পর বাংলাদেশে দুই বছর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেনা সমর্থক তত্ত্বাবধায়ক নামের ওই সরকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের জেলে পাঠায়। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম মিথ্যা মামলা দিতে থাকে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাব জেলে পাঠায়। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ঐতিহ্য ও নেতা-কর্মীদের দৃঢ়তার কাছে টিকতে পারেনি দেশবিরোধী এই অপশক্তিগুলো। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিলাভ করেন।আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণেই ২০০৮ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। যেখানে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে দলটি। তখন থেকেই উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার সফলতার গল্প আজ শুধু জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক পর্যায়ে নয়, গোটা পৃথিবীতে তাঁর সাফল্যের কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় ধরে নেতৃত্ব দেয়া জাতীয় নেতা। অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার মতো সফলতা পাওয়া নেতা পৃথিবীতে বিরল।
গত দুই দশকে পৃথিবীর কোনো জাতীয় নেতা শেখ হাসিনার মতো এরকম সফলতা দেখতে পারেনি। তাঁর সফলতার গল্প আজ বিশ্ব নেতাদের মুখে মুখে। তাঁর উন্নয়ন কৌশল আজ পৃথিবীর নানা দেশ অনুসরণ করছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে আজ সফলতার এক প্রতীক। তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে। যদি আমাদের একজন শেখ হাসিনা না থাকতো, তাহলে কি হতো? এই উন্নয়ন ও বিশ্বের বুকে মর্যাদার অবস্থান কী আমরা পেতাম? স্বাধীনতার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক-জঙ্গি মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নও কী আমরা দেখতে পেতাম?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম